বকশীগঞ্জে ৩১ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকট : রোগীদের চরম ভোগান্তি! – দৈনিক আজকের জামালপুর

বকশীগঞ্জে ৩১ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকট : রোগীদের চরম ভোগান্তি! – দৈনিক আজকের জামালপুর




বকশীগঞ্জে ৩১ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকট : রোগীদের চরম ভোগান্তি! – দৈনিক আজকের জামালপুর



জিএম ফাতিউল হাফিজ বাবু : জামালপুরের বকশীগঞ্জে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ৩১ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম। একারণে ভেঙে পড়েছে এই হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা না পেয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা ও ক্ষোভ। এছাড়াও হাসপাতালের না সমস্যা সমাধান ও চিকিৎসকের শুন্য পদ পূরণ করে রোগীদের সেবা কার্যক্রম জোড়দার করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম হাসপাতালের চিকিৎসক ও জনবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস প্রদান করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামালপুরের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তঘেষা এলাকা বকশীগঞ্জ উপজেলা। পাহাড়, নদী ও চর নিয়ে গঠিত এই উপজেলার বেশির ভাগ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে থাকেন। জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উপজেলার মানুষের চিকিৎসাসেবার মাধ্যম বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
১৯৮৩ সালে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকারি এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার কিছু বছর ভালভাবে পরিচালিত হলেও বর্তমানে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে নাকাল হয়ে পড়েছে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। নানা কারণে এই হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী হয়ে পড়েছে।
এই হাসপাতালে বকশীগঞ্জ উপজেলার বাইরে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন, ইসলামপুর উপজেলার ২ টি ইউনিয়ন, শ্রীবরদী উপজেলার ২ টি ইউনিয়ন ও কুড়িগ্রামের রৌমারী এবং রাজীবপুর উপজেলার রোগীরাও চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এতে করে প্রায় ৬ লাখ মানুষের ভরসাস্থল হয়ে পড়েছে বকশীগঞ্জ উপজেলার সরকারি এই হাসপাতালটি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ৩১ শয্যা থেক ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কাগজে কলমে ৫০ শয্যা উন্নীত হলেও প্রশাসনিক জটিলতায় এখনো ৩১ শয্যার কার্যক্রমই চলমান রয়েছে। বর্তমানে এই হাসপাতালে চরম আকারে চিকিৎসক সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে কর্মচারী সংকটও। ৩১ শয্যার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সহ ১০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ৩ জন। এই ৩ জন চিকিৎসক দিয়েই চলছে প্রায় ৬ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আন্ত: বিভাগের রোগীদের সামলাতে হয় আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও একজন মেডিকেল অফিসারকে।
এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ৫শ থেকে ৬শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন।
বহির্বিভাগে মেডিকেল অফিসার না থাকায় বিভিন্ন ইউনিয়নের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এছাড়াও জুরুরী বিভাগেও চিকিৎসা দেওয়া কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার দিয়ে। ফলে অনেক রোগীকে চিকিৎস না দিয়েই জেলা বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে শুন্য রয়েছে জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনী, জুনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারী চিকিৎসকের পদ। মেডিকেল অফিসারের দুটি পদই বর্তমানে শুন্য রয়েছে। জুনিয়র কনসালটেন্ট এনেন্থেসিয়া ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল অফিসার পদে এক করে থাকলেও তারা দুজনই জামালপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে সেবা দিয়ে থাকেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও সঙ্কটে রয়েছে। মিডওয়াইফাই চার জনের পরিবর্তে রয়েছে দুই জন, আয়া দুজনের মধ্যে আছে এক জন, নিরপত্তা কর্মী দুজনের মধ্যে আছে একজন, অফিস সহায়ক পদে চার জনের মধ্যে আছে তিন জন, ওয়ার্ড বয় তিনজনের মধ্যে আছে দুই জন করে। এছাড়াও মালি পদে শুন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন থিয়েটার (ও.টি) বন্ধ থাকায় করা হয় না কোন অপারেশন। ফলে সিজারের রোগীদের বাইরের ক্লিনিকে সিজার করাতে হয়। প্রায় দুই মাস ধরে বিকল হয়ে রয়েছে এক্স রে মেশিনটি। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটিও পড়ে রয়েছে বিকল হয়ে। তবে ইসিজি সার্ভিস চালু রয়েছে। জেনারেটর নষ্ট হওয়ায় বিদ্যুৎ না থাকলেও গরমে হাসফাস ও মোমবাতি জ্বালিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের।
আন্ত:বিভাগে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী ভর্তি থাকে। শয্যার চেয়ে রোগী বেশি থাকায় অনেক সময় হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের। বাড়তি রোগী থাকায় খাবারের সংকট দেখা যায় এখানে। একারণেও রোগীর স্বজনদের মধ্যে রয়েছে চরম ক্ষোভ। এই হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী না থাকায় বেশির ভাগ সময় ময়লা, আবর্জনা ও দুর্গন্ধ সহ্য করতে হয় রোগীদের। ৫ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদ থাকলেও এই হাসপাতালে একজনও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নেই। মাঝে মাঝে ধার করা পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের হাসপাতাল পরিস্কার করা হয়।
এই হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানান রোগীরা।
চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, এই হাসপাতালে রোগী বেশি কিন্তু সেবা কম। পর্যাপ্ত রোগী থাকলেও নেই চিকিৎসক। ফলে মাত্র ৩ জন চিকিৎসক দিয়ে এতো রোগীর ভাল চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়ে উঠে না। রোগীর চাপে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের।
তাই চিকিৎসকের শুন্য পদ পূরণ করা, আধুনিক সরঞ্জামাদী সরবরাহ করা ও জনবল কাঠামো নিয়োগ করে কল্যাণমুখি চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম জোড়দার করার দাবি জানান সাধারণ মানুষ।
এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মান মোটেও ভাল নয়। চাহিদা সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় কোনমতে চলছে রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম। রোগীরা রয়েছেন নিরাপত্তাহীনতায়। মাঝেমধ্যে চোরের উপদ্রপ বৃদ্ধি হয় এবং রোগীদের জিনিসপত্র খোয়া এখানে। তাই দ্রুত জনবল নিয়োগ করে চিকিৎসক সংকটের সমাধানের দাবি জানান তারা।
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মনছুরা আক্তার কল্প ও রোকেয়া আক্তার জানান, আমাদের ইচ্ছা থাকলেও রোগীদের চাহিদামত সেবা দিতে পারছি না। এই হাসপাতালে রোগীদের এতো চাপ থাকে যে একারণে স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। ফলে রোগীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে রোগীদের নিয়ে আমাদের কোন অবহেলা নেই।
বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম বলেন, এই হাসপাতালে বিভিন্ন উপজেলা থেকেও চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রতিদিন কয়েকশ রোগীর ভীড় থাকে আউটডোর ও জুরুরী বিভাগে। মাত্র ৩ জন চিকিৎসক দিয়ে এতো গুলো রোগীর চিকিৎসা দেওয়া আমাদের জন্য কষ্টের। তবুও আমরা সাধ্যমত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। জনবল সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন। বর্তমানে চিকিৎসকের যে সংকট রয়েছে ৪৮ তম বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হলেই আশাকরি এই সংকট কেটে যাবে। পাশাপাশি ৫০ শয্যা কার্যক্রম চালু করতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
দ্রুত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ দিয়ে এই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বৃদ্ধি করা সহ হাসপাতালটিকে চিকিৎসা উপযোগী করে তোলা উচিত বলে মনে স্থানীয়রা।


Explore More Districts