বাংলাদেশে লায়নিজমের জনক মরহুম এম আর সিদ্দিকীকে একজন কিংবদন্তী হিসেবে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, এম আর সিদ্দিকী শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজসেবায়ও নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এম আর সিদ্দিকীর মতো মানুষরাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন; আমরা যে সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখি সেই সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। বক্তারা এমআর সিদ্দিকীর কোনো তুলনা চলে না বলেও মন্তব্য করেন। গতরাতে নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট এন্ড হসপিটাল ও চট্টগ্রামস্থ পাঁচ হাসপাতালের মধ্যে রেটিনা রোগ গবেষণায় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, ৩য় বার্ষিক সম্মেলনের প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান, গালা নাইট এবং এম আর সিদ্দিকী স্মরণ বক্তৃতায় বক্তারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে একাডেমিক সহযোগিতা বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে এবং রেটিনা রোগের এআই–নির্ভর স্ক্রিনিং কার্যক্রম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কেরানিহাট, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ডায়াবেটিক হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়। চট্টগ্রাম লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সঙ্গে একাডেমিক সহযোগিতা, ক্লিনিক্যাল সংযুক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতা বিনিময়, যৌথ গবেষণা এবং প্রকাশনা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. তনুজা তানজিন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রতিরোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে রেটিনা রোগের প্রাথমিক সনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে রাঙামাটি ডায়াবেটিক হাসপাতালের পক্ষে ডা. পরশ খীসা, খাগড়াছড়ি ডায়াবেটিক হাসপাতালের পক্ষে বিম্বিশার খীসা, বান্দরবান ডায়াবেটিক হাসপাতালের পক্ষে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক এবং কেরানিহাটের অল কেয়ার ডায়াবেটিক হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পক্ষে আবু বকর সিদ্দিকী সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।
চট্টগ্রাম লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান লায়ন নাসির উদ্দিন চৌধুরী সকল সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।
অনুষ্ঠানে এমএলওপি কোর্সের দুই ব্যাচের উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন কমিউনিটি অপথালমোলজি, এফসিপিএস পার্ট–১ ও ফাইনাল এবং চক্ষু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ফেলোশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ডা. অনিন্দিতা চৌধুরী ও অপটোমেট্রিস্ট মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে এমএলওপি কোর্স পরিচালনায় এবং ডা. শেখ মোহাম্মদ মুরাদ ও ডা. প্রিয়া মিত্রকে ডিপ্লোমা ইন অপথালমোলজি (উঙ) কোর্স পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে ও রেটিনা রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য রেটিনা রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এম. এ. রকীবকে ‘বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সম্মাননা’ প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেশনে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক, মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক, দেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশে লায়নিজমের জনক ও চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লায়ন এম আর সিদ্দিকীর জীবনী নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডা. লাবণ্য দাশ এবং লায়ন এম আর সিদ্দিকীর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বিশেষ স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন দেশের প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী এবং প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন চেয়ারম্যান লায়ন এম এ মালেক।
লায়ন নাসির উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রাক্তন জেলা গভর্নরদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন চেয়ারম্যান লায়ন এমএ মালেক ও লায়ন নজমুল হক চৌধুরী, লায়ন আলহাজ্ব রফিক আহমেদ, লায়ন ডা. শ্রীপ্রকাশ বিশ্বাস, লায়ন সিরাজুল হক আনসারী, লায়ন মোহাম্মদ মোস্তাক হোসাইন, লায়ন আল শাহাদাৎ দোভাষ, সদ্য প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন কোহিনুর কামাল, লায়ন্স জেলা ৩১৫–বি৪, বাংলাদেশ–এর জেলা গভর্নর লায়ন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ অপু, ১ম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোহাম্মদ কামরুজ্জামান লিটন এবং ফাউন্ডেশনের পক্ষে ভাইস–চেয়ারম্যান প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক, সেক্রেটারি লায়ন ডা. দেবাশীষ দত্ত, ট্রেজারার লায়ন এস. জোহা চৌধুরী, অ্যাসোসিয়েট সেক্রেটারি লায়ন এস. এম. আশরাফুল আলম আরজু, গভর্নিং বডির লায়ন নেতৃবৃন্দ, একাডেমিক ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. প্রকাশ কুমার চৌধুরী, হাসপাতালের উপ–পরিচালক ডা. শাবানা সুলতানা, সহকারী পরিচালক ইনসাফি হান্নাসহ হাসপাতালের সকল চিকিৎসক, কর্মকর্তা–কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলন।
ফাউন্ডেশনের ভাইস–চেয়ারম্যান প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক চট্টগ্রাম লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উদ্যোগে আয়োজিত ৩য় বার্ষিক সম্মেলন সাফল্যকরণে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী এম আর সিদ্দিকীকে কিংবদন্তী হিসেবে উল্লেখ করে তার জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি এম আর সিদ্দিকীকে একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাঁর মতো মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন বলেই আজ দেশের হাজার হাজার মানুষ লায়ন্সের চক্ষু চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারছে। দেশের মানুষের অন্ধত্ব দূরীকরণে মরহুম এম আর সিদ্দিকীর ভূমিকা যুগের পর যুগ আলোচিত হবে বলেও ডা. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী সম্পাদক লায়ন এম এ মালেক ইংরেজি একটি উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, আমরা নিজেদের জন্য যা করি, তা আমাদের সাথে হারিয়ে যায়। কিন্তু অন্যের জন্য, পৃথিবীর জন্য যা করি, তা থেকে যায়। মরহুম এম আর সিদ্দিকীর জীবন এই কথারই প্রকৃষ্ট উদাহারণ।
এম এ মালেক বলেন, এম আর সিদ্দিকী নিজের কর্মকাণ্ড দিয়ে আমাদের শিখিয়ে গেছেন যে, আমরা কী পেয়েছি তা দিয়ে আমাদের জীবন অর্থবহ হয় না, আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষের জন্য মানবতার জন্য কতটুকু করতে পেরেছি সেটিই আমাদের সাফল্যের মাপকাঠি।
এম এ মালেক বলেন, তাঁর সেবার মনোভাব আজো আমাদের ভিতরে অনুপ্রেরণার উৎস। আমি নিশ্চিত, আগামী দিনগুলোতেও অনাগত প্রজন্ম তাঁকে একইভাবে সম্মান ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে। এটাই তাঁর মানবিক কর্মকাণ্ডের বড় স্বীকৃতি। একজন মানুষ চলে যাওয়ার পরও যদি তাঁর কাজ অন্যদের পথ দেখায়, তাহলে প্রকৃত অর্থে তিনিই সফল মানুষ। এম আর সিদ্দিকী সেই সফল মানুষ বলেও এম এ মালেক মন্তব্য করেন।
সিএলএফ চেয়ারম্যান লায়ন নাসিরউদ্দিন চৌধুরী এম আর সিদ্দিকীর অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত লায়ন্স ফাউন্ডেশন আজ চট্টগ্রামের সেবার জগতে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটিকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, চোখের চিকিৎসায় যেদিন আমাদের দেশের মানুষকে আর বিদেশে যেতে হবে না, সেদিনই আমাদের স্বপ্ন সফল হবে। রোগীদের এই আস্থা এবং ভরসার জায়গায় যাওয়ার জন্য লায়ন্স আই ইন্সস্টিটিউট এবং হসপিটালের প্রতিজন কর্মী নিরলসভাবে কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি এবছরই চট্টগ্রামে এআই নির্ভর রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এই প্রযুক্তি দেশের চক্ষু চিকিৎসাসেবায় বিপ্লব সাধন করবে। দেশের মধ্যে চট্টগ্রামেই প্রথম এই প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা শুরু করতে যাচ্ছি। এটা আমাদের একটি অহংকারের জায়গা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ফাউন্ডেশনের ভাইস–চেয়ারম্যান প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক লায়ন এম আর সিদ্দিকীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন, বাংলাদেশে তিনি শুধু লায়নিজমই শুরু করেননি, সেবার দুয়ারও খুলে দিয়েছিলেন। লায়ন্স ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মরহুম এম আর সিদ্দিকী দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দোরগোড়ায় যেভাবে মানবতা, মানবিকতা, সেবা এবং চিকিৎসা পৌঁছে দিয়েছিলেন তার আসলে তুলনা চলে না। তাঁর দূরদৃষ্টি এবং সৃজনশীলতাই বাংলাদেশের লায়ন সদস্যদের আজও আলোর পথ দেখাচ্ছে।



