
টরন্টো, ১৮ নভেম্বর – নীল আকাশে সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছিল। অগ্রাহায়ণের হিমশীতল বাতাসে টরন্টোর রাস্তাঘাটে যেন এক ভিন্ন রকম প্রশান্তির ছোঁয়া। সেই সময়ে শহরের ‘দ্যা ডন অন ড্যানফোর্থ’ মিলনায়তনে শুরু হল এক সন্ধ্যা, যার কেন্দ্রে ছিল সুরের আলোকচ্ছটা আর মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি। গত শনিবার শিল্পী শিরীন চৌধুরীর একক সঙ্গীত সন্ধ্যা ‘পরান যাহা চায়’ যেন অগ্রাহায়ণের সন্ধ্যাকে পরিণত করল আবেগে ও সৌন্দর্যে ভরা এক সুরলোকের উৎসবে।
শিরীন চৌধুরী মঞ্চে উঠতেই হলভর্তি দর্শকদের করতালি আর উচ্ছ্বাসে পরিবেশ মুহূর্তেই সরব হয়ে উঠল। মা ও ছেলের যুগল কণ্ঠে যা সৃষ্টি হল, তা কেবল গান নয়, এক অসামান্য আবেগের নদী। যার স্রোতে ভেসে গেল মিলনায়তনের প্রতিটি মানুষ। সুষ্ময়ের তরুণ, নির্মল কণ্ঠ এবং শিরীনের কোমল, পরিণত সুর মিলেমিশে দর্শকের অন্তরকে ছুঁয়ে দিল অপার মমতায়।
লালন সাঁইয়ের গান দিয়ে শুরু হল সঙ্গীতযাত্রা। মঞ্চে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে লালনের দর্শন, মানুষের ভেতরের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার সেই চিরন্তন বোধ। শিরীন চৌধুরীর কণ্ঠে সেই আত্মিক অনুসন্ধান যেন আরও গভীর হয়ে উঠল। লালনের প্রতিটি গানের ভেতর আছে যে মানবতার দর্শন, সেই দর্শনই সেদিন নতুনভাবে আলো ফেলল। কবিগুরু স্বয়ং বলেছেন, “লালন ফকিরের গানে যে গভীরতা ও উদারতা আমি দেখিয়াছি, তা অন্য কোথাও দেখি নাই।” সেই গভীরতার স্পর্শই অনুভূত হল শ্রোতাদের হৃদয়ে।
মা ও ছেলে যখন গাইলেন “কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে”, তখন হলভর্তি মানুষের চোখে ভেসে উঠল আবেগের জমে থাকা জল। চারদিকে এক নিঃশব্দ আকুলতা। মা-ছেলের গলায় সুরটি যেন জীবনের দুঃখবোধ ও মায়ার সবটুকু তুলে ধরল।

এই আয়োজন শুধু গানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রতিবেশী সুরের বুননেও সমৃদ্ধ ছিল। দর্শকদের মুগ্ধ করে আহমেদ হোসেনের লালন আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথন, ভিনদেশী বাঁশিবাদক-এর বাঁশির স্নিগ্ধ সুর, রূপতনু শর্মার কিবোর্ড, রাজীবের তবলার তাল আর আবিরের গিটারের অনবদ্য সঙ্গত। পুরো মিলনায়তন যেন হয়ে উঠেছিল এক সুরের বাগান।
দর্শকদের ভালোবাসা ও উচ্ছ্বাসে ভেসে শিরীন চৌধুরী তাঁর অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি লালনসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভিনকে। এই মুহূর্তটি অনুষ্ঠানকে আরও তাৎপর্যময় করে তোলে।

সন্ধ্যার আবহে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশিদের গর্ব, স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট-এর এমপিপি ডলি বেগম।
শিরীন চৌধুরীর সেদিনের সংগীত সন্ধ্যার আবহ শেষ পর্যন্ত কেবল একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সুরে সুরে যেন সৃষ্টি হয়েছিল অনুভূতির এক বিস্তৃত জগৎ।
১৮ নভেম্বর ২০২৫



