সিডরের ১৮ বছর: উপকূলবাসী এখনো ভুগছে

সিডরের ১৮ বছর: উপকূলবাসী এখনো ভুগছে

১৫ November ২০২৫ Saturday ৬:৩৫:২৭ PM

Print this E-mail this


বরগুনা প্রতিনিধি:

সিডরের ১৮ বছর: উপকূলবাসী এখনো ভুগছে

আজ ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। এর ধ্বংসলীলায় মুহূর্তেই পাল্টে যায় উপকূলীয় জনপদের চিত্র। ভেসে যায় বহু মানুষ, ঘরবাড়ি আর পশুপাখি। আজও সেই দুঃসহ দিনের কথা মনে করে আঁতকে ওঠেন উপকূলবাসী। তবে সিডরের ধ্বংসলীলার ১৮ বছরেও বরগুনার উপকূলীয় এলাকায় নির্মাণ করা হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ঝড়ের সংকেত মানেই যেন মৃত্যু-আতঙ্ক।

পরিবেশকর্মী আরিফ রহমান বলেন, বরগুনার উপকূলীয় মানুষের প্রধান দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের আতঙ্কে থাকা মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

সরকারি হিসাবে, সিডরে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজের সংখ্যা ১৫৬। ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যায় ৩০ হাজার ৪৯৯ গবাদিপশু এবং ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯ হাঁস-মুরগি। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪ পরিবার।

বরগুনায় সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সদর উপজেলার নলটোনা গ্রাম। সিডরের এক বছর আগে থেকে গ্রামটিতে কোনো বেড়িবাঁধ ছিল না। সেদিন এখানে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ২০ ফুট। ঝড় থেমে গেলে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনো এলাকা পানির নিচে। ফলে লাশ দাফনের জন্য শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না।

পরে মরদেহগুলো নেওয়া হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। কাফনের কাপড় ছাড়াই ১৯টি কবরে দাফন করা হয় ৩০ জনকে। পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে চারটি কবরে তিনজন করে ১২ জন, তিনটিতে দুজন করে ছয়জন এবং ১২টিতে একজন করে ১২ জনের লাশ দাফন করা হয়।

টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে এখনো ভুগছে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। প্রতিনিয়ত ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, ভেসে যাচ্ছে চিংড়ির ঘের।

বরগুনার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই উপকূলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক জায়গায় পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কিছুটা বাড়লেই ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। তাই এখানে উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় ৮০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটারই নিম্ন উচ্চতার। সম্প্রতি ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধের ১৩ কিলোমিটারের তীর সংরক্ষণ, ৯ কিলোমিটারের ঢাল সংরক্ষণ এবং ৫১ কিলোমিটার মেরামতের কাজ শেষ হয়েছে। আরও ৫০ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন সদর উপজেলার নিশানবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আসলাম খান। সেদিন নিজে প্রাণে বেঁচে গেলেও হারিয়েছেন স্ত্রী ও সন্তানকে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘১৮ বছর ধরে টেকসই বেড়িবাঁধের স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি, কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের কষ্টের কথা কেউ শুনতে চায় না।’

বরগুনার মাঝের চরের বাসিন্দা মহসীন আলী বলেন, ‘আমাদের চরটি অর্ধেক বরগুনা আর অর্ধেক পাথরঘাটায় অবস্থিত হওয়ায় কোনো উপজেলা থেকে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেওয়া হয় না। সিডরের পর থেকে নানা দুর্যোগে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে স্বাভাবিক জোয়ারেই আমাদের চর প্লাবিত হয়। বন্যা কিংবা জলোচ্ছ্বাস এলে তো কথাই নেই।’

বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, জেলায় অনেকগুলো প্রকল্পের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে টেকসই বাঁধের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কিছুটা হলেও জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রেহাই মিলবে। এ ছাড়া অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের কীভাবে সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা যায়, তা নিয়েও কাজ চলছে।

সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক


শেয়ার করতে ক্লিক করুন:

Explore More Districts