২৩ October ২০২৫ Thursday ১:২৫:১৯ AM | ![]() ![]() ![]() ![]() |
বিশেষ প্রতিনিধি:

ধান, নদী আর খালের শহর বরিশালের বুকের মাঝখানে শতবর্ষী এক জলাশয় বিবির পুকুর। একসময় এই পুকুর ছিল শহরের প্রাণ। ঝকঝকে স্বচ্ছ পানি, আশপাশে মানুষের আড্ডা, শিশুরা খেলে বেড়ায়, বাতাসে ভেসে বেড়াত জীবন আর ইতিহাসের গন্ধ। আজ সেই পুকুর আর আগের মতো নেই।পানির গভীরতা কমেছে, স্বচ্ছতা হারিয়েছে, আর ইতিহাসের আলোও যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
সৌন্দর্য ফেরাতে ফোয়ারা বসানোর কাজ চললেও, নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে পুকুরের দক্ষিণ পাশে। গতকাল মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) গভীর রাতে সেখানে বসানো হয়েছে লোহার গরাদ, যেন এক বিশাল খাঁচা। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার প্রস্তুতিও চলছে নেট দিয়ে।
স্থানীয়দের আশঙ্কা এই খাঁচায় হারিয়ে যাবে বিবির পুকুরের খোলা আকাশ, মুক্ত সৌন্দর্য। এর আগেও শহরের আরেক প্রান্তে, বেলস পার্ক লেক ঘিরে দেওয়ার উদ্যোগে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে খবর ছাপা হলে নাগরিকদের মানববন্ধন, চিত্রাঙ্কন আর স্মারকলিপির পর সেই কাজ স্থগিত হয়। তবে এবার যেন সেই পুরনো গল্পই ফিরে আসছে বিবির পুকুরে।
বিবির পুকুর শুধু একটি জলাশয় নয়, এটি ইতিহাসের ধারক। জানা যায়, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরি ১৮০০ সালের দিকে বরিশালে এসে এক মুসলিম মেয়েকে পর্তুগিজ দস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। নাম রাখেন জিন্নাত বিবি। নিঃসন্তান এই নারী ১৯০৮ সালে নিজের জমিতে এই পুকুর খনন করেন মানুষের উপকারে। সেই থেকে জলাশয়টির নাম, বিবির পুকুর।
প্রায় ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮৫০ ফুট প্রস্থের এই জলাশয় একসময় কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে দুটি খাল দিয়ে সংযুক্ত ছিল। নদীর জোয়ারে পানি এসে ভরে দিত পুকুর, মাছও আসত। কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই খাল আজ বিলুপ্ত, আর পুকুরটিও হয়ে পড়েছে বদ্ধ ও নিস্তরঙ্গ। কয়েক বছর আগে প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন পুকুর ঘিরে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেন। পার্ক, বেঞ্চ, আলোকসজ্জা, ফোয়ারা; সব ছিল সেই পরিকল্পনায়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে সেই জৌলুস। পুকুরের দক্ষিণ পাশে অবৈধ দোকান উঠলেও কিছুদিন পর আবার বসানো হয় করপোরেশনের অনুমতিতে।
স্থানীয় কবি ও ইতিহাসবিদ হেনরি স্বপন বলেন, ‘একসময় বিবির পুকুর ছিল আমাদের শহরের গর্ব। এখন সেখানে মাছ চাষ, দোকান, ময়লার গন্ধ— সব মিলিয়ে জীর্ণ অবস্থা। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা যেন এই জায়গাটাকেই ভুলে গেছেন। যে শহর নিজের জলাশয় বাঁচাতে পারে না, সে তার ইতিহাসও টিকিয়ে রাখতে পারে না।’ বরিশাল সিটি করপোরেশনের বাজার কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, কিছু ব্যক্তি অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে ভাড়া তুলছিলেন, তাই উচ্ছেদ করা হয়েছে। বৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য স্টিকার দেওয়া হচ্ছে, প্রতিদিন ৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ময়লা যাতে পুকুরে না পড়ে, সে জন্যই গ্রিল ও নেট বসানো হচ্ছে। তিনি আরো জানান, পুকুরটি এখন স্থানীয় ব্যবসায়ী কালু সিকদারের ইজারায় রয়েছে এবং সেখানে মাছ চাষ চলছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী জানান, ফোয়ারার কাজ প্রায় শেষ। কাজ শেষ হলে বিবির পুকুর তার আগের রূপ ফিরে পাবে। নাগরিকরা বলছেন, পুকুরকে ঘিরে গরাদ নয়, প্রয়োজন নিয়মিত যত্ন আর রক্ষণাবেক্ষণ। নইলে ইতিহাসের সাক্ষী এই বিবির পুকুর শুধু একটি মাছ চাষ প্রকল্পেই রূপ নেবে। সৌন্দর্য নয়, বরং হয়তো এই খাঁচার ভেতর হারিয়ে যাবে তার শেষ নিঃশ্বাসটুকুও।
সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক
শেয়ার করতে ক্লিক করুন: | Tweet |