তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বিভাগীয় শহর সিলেটে এখনো হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থা। ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে দাঁড়িয়ে এমন বাস্তবতা শুধু বিস্ময়করই নয়, বরং নগর ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের অবহেলার প্রতিফলন।
সিলেট নগরী—ছিল সময়ের শান্ত, সবুজে মোড়া ছোট্ট শহর। আশির দশকে এই শহরের রাস্তাঘাট ছিল সরু, যানবাহনের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। তবুও তখন শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। নগরীর ব্যস্ততম পয়েন্টগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিল ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট, যা সে সময়ের জন্য ছিল ব্যতিক্রমধর্মী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
নব্বইয়ের দশকে এসে সেই সিগন্যাল ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করার পদক্ষেপ নেয় সিলেট সিটি করপোরেশন। ১৯৯৬ সালে ‘মাঝারি শহর উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর ছয়টি ব্যস্ততম স্থানে—চৌহাট্টা, রিকাবিবাজার, নয়াসড়ক, সুরমা মার্কেট, নাইওরপুল ও আম্বরখানা পয়েন্টে—স্থাপন করা হয় নতুন ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেই সিগন্যাল লাইটগুলো কোনো দিনই কাজ করেনি। প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও একদিনের জন্যও জ্বলেনি লাল, সবুজ কিংবা হলুদ বাতি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর দুই-একটি মোড়ে সিগন্যাল লাইটগুলোর খুঁটি এখনও জীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও বাতিগুলোর চিহ্নও নেই। নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণ। এসব দৃশ্য যেন এক নিঃশব্দ সাক্ষী—সিলেটের অচল ট্রাফিক ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার।
২০১৭ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সিলেটকে দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল সিটি’ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়। সেই লক্ষ্যেই নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ—স্মার্ট সড়ক, ওয়াইফাই জোন, অনলাইন সেবা ইত্যাদি। কিন্তু এই ডিজিটাল শহরেই এখনো যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুরোনো অ্যানালগ ধারায় চলছে। এখনো নগরীর প্রতিটি মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলাচল করছে যানবাহন। ফলে যানজট, বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী পিপিএম দৈনিকসিলেটডটকমকে বলেন, “সিগন্যাল বাতি না থাকায় এখনো আমাদের ট্রাফিক সদস্যদের হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। লোকবল সংকটের পাশাপাশি যানবাহনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সিগন্যাল চালু থাকলে কাজ অনেক সহজ হতো, সারাদিন সড়কে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াতে হতো না।”তিনি আরও জানান, ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট চালুর বিষয়ে ইতোমধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। করপোরেশন জানিয়েছে—এ বিষয়ে একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা চলছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “খুব শিগগিরই নগরীতে জেব্রাক্রসিং ও রোড সাইন বসানো হবে।”
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার দৈনিকসিলেটডটকমকে বলেন, “সিলেট মেট্রোপলিটন শহরে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকা সত্যিই বিস্ময়কর। আমরা খুব শিগগিরই একটি আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। প্রয়োজনে ট্রাফিক বিভাগকে সম্পৃক্ত করে যৌথভাবে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।” তিনি আরও বলেন, “বাজেট ঘোষণার সময় নানা খাত সংযুক্ত করা হয়, তবে বাস্তবায়ন নির্ভর করে সরকারি বরাদ্দের ওপর। আশা করছি, সিগন্যাল প্রকল্পটি অগ্রাধিকারে থাকবে।”
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সিলেট শহরের বিভিন্ন মোড়ে—বিশেষ করে জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, নয়াসড়ক ও আম্বরখানা এলাকায়—যানজট এখন নিত্যদিনের চিত্র। অনেক সময় স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে, অফিসগামী মানুষকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
দৈনিক নয়াদিগন্তের ব্যুরো প্রধান ও সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল কাদের তাপাদার বলেন,“একটা সময় সিলেট ছিল ছোট ও শান্ত শহর। তখনও নগরীতে ট্রাফিক সিগন্যাল ছিল, যান চলাচলও ছিল নিয়মের মধ্যে। অথচ এখন নগরীর পরিধি বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ, কিন্তু আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই—এটা দুঃখজনক। প্রতিদিন সকাল-বিকেলে অফিসে যেতে হয় যেন যুদ্ধ করে। নগরীর ব্যস্ততম মোড়গুলোয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হলে যানজট অনেকটাই কমে আসবে, শহরটাও পাবে এক ধরনের শৃঙ্খলা।”
চৌহাট্টা এলাকার মোটরচালক শফিকুন নূর বলেন, “পুলিশের ইশারায় একসাথে পাঁচ দিক থেকে গাড়ি আসে, তখন দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। সিগন্যাল থাকলে এই বিশৃঙ্খলা অনেকটাই কমে যেত।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্ট সিটি গড়তে হলে শুধু ভবন বা আলোকসজ্জা নয়—প্রয়োজন স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল, রিয়েল-টাইম মনিটরিং, পথচারীবান্ধব জেব্রাক্রসিং এবং ট্রাফিক পুলিশের আধুনিক প্রশিক্ষণ ছাড়া ‘ডিজিটাল সিলেট’ ধারণা অপূর্ণই থেকে যাবে।
তিন দশক আগে স্থাপন করা ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির জীর্ণ খুঁটি আজও নগরীর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে—একটি অবহেলিত নগর ব্যবস্থার নীরব সাক্ষী হয়ে। সিলেটবাসীর প্রত্যাশা, সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগ যৌথভাবে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, যাতে আগামী প্রজন্ম অন্তত দেখতে পারে—স্মার্ট সিলেটে লাল, সবুজ ও হলুদ বাতির আলোকেই শৃঙ্খলিত হচ্ছে যানচলাচল।