দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
বাংলাদেশের জ্বালানি কৌশলে মৌলিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পুরোপুরি চালু হলে এটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে—যেখানে থাকবে অধিক আত্মনির্ভরতা, দক্ষতা এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা। ইতোমধ্যে পারমাণবিক জ্বালানির ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ৩৩তম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
সূত্র জানায়, চলতি মাসেই পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর জন্য জোর প্রস্তুতি চলছে। রাশিয়ার প্রযুক্তি ও অর্থায়নে নির্মিত এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিট এ বছরই চালু হওয়ার কথা রয়েছে, যা জাতীয় গ্রিডে ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত করবে। পূর্ণ সক্ষমতায় পৌঁছালে এই কেন্দ্র থেকে মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে, যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করবে।
১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রূপপুর হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২২ হাজার ৫২ কোটি টাকা এবং বাকি ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা রাশিয়ার ঋণ সহায়তা। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর, আর পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ শুরু হয় ২০১৭ সালে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট মূল ঠিকাদার হিসেবে দুটি ১,২০০ মেগাওয়াট ইউনিট নির্মাণ করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রূপপুরের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে তা শুধু বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণই নয়, বরং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং কৌশলগত স্বনির্ভরতা অর্জনের দিকেও এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে।
তাঁরা আরও বলেন, দেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির যে অতিনির্ভরতা তৈরি হয়েছে, তাতে বড় মাত্রায় কাটছাঁট ঘটাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যদিও প্রকল্পের ব্যয় কাঠামো ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তবুও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রূপপুরের সফল বাস্তবায়ন দেশের বিদ্যুৎ খাতে কাঙ্খিত ভারসাম্য ফেরাবে। আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় কাঠামোতেও বড় প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে কম সক্রিয় হলে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহও আরও স্থিতিশীল হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত থেকে ২,৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে, যা জাতীয় মোট চাহিদার প্রায় ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলে আদানি গ্রুপ ও জিটুজি (সরকার-সরকার চুক্তি) ভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। তবে রূপপুর চালু হলে ওই অঞ্চলে জাতীয় গ্রিড থেকেই বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। এতে করে ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির নির্ভরতা প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, রূপপুরকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করতে ইতোমধ্যে চারটি উচ্চক্ষমতার সঞ্চালন লাইন—বগুড়া, গোপালগঞ্জ, কালিয়াকৈর ও বাঘাবাড়ীর সঙ্গে—নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বিপিডিবি জানায়, তারা রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ নিতে প্রস্তুত এবং উত্তরাঞ্চলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে।
রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাসান জানান, এখন পরবর্তী ধাপে চুল্লিতে ফুয়েল লোডিং (জ্বালানি স্থাপন) হবে। এরপর তিন থেকে চার মাস ধরে ধাপে ধাপে কম ক্ষমতায় পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন চলবে। প্রতিটি ধাপে সফলতা নিশ্চিত হওয়ার পরই পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
তিনি বলেন, “সব প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।”
প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয়েছিল জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। তবে গত বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে চুক্তি অনুসারে মেয়াদ বাড়লেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খরচ বাড়াতে পারবে না।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্থিক লেনদেন জটিলতা, যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আগমন বিলম্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে বিল পরিশোধের অসুবিধার কথা উল্লেখ করা হয়।
এ পর্যন্ত ছয়টি সঞ্চালন লাইন নির্মিত হয়েছে—রূপপুর-বাঘাবাড়ি (৬৫ কিমি), রূপপুর-বগুড়া (১০২ কিমি), আমিনবাজার-কালিয়াকৈর (৫১ কিমি), রূপপুর-গোপালগঞ্জ (১৪৪ কিমি), রূপপুর-ঢাকা (১৪৭ কিমি) এবং রূপপুর-ধামরাই (১৪৫ কিমি)।
এক সাক্ষাৎকারে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মনজুরুল হক বলেন, রূপপুর প্রকল্পের মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সফলতা অর্জিত হতে যাচ্ছে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে পুরো সিস্টেমটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার ওপর।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ব পারমাণবিক ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে জ্ঞান বিনিময় বাড়ানোর দিকেও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে হবে।
