বরগুনার প্রতিটি বাড়ি যেন এডিস মশার প্রজননকেন্দ্র

বরগুনার প্রতিটি বাড়ি যেন এডিস মশার প্রজননকেন্দ্র

২ July ২০২৫ Wednesday ৪:৫৫:১৩ PM

Print this E-mail this


বরগুনা প্রতিনিধি:

বরগুনার প্রতিটি বাড়ি যেন এডিস মশার প্রজননকেন্দ্র

বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাসায় রক্ষিত ফুলের টব, বাথরুমে ব্যবহৃত বালতি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাত্রসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে পাওয়া গেছে এডিস মশার লার্ভা। এ ছাড়া বাড়ির উন্মুক্ত স্থানে জমে থাকা পানিতেও মিলেছে লার্ভা। এক কথায় বরগুনার প্রতিটি বাড়িই যেন এডিস মশার প্রজননকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বরগুনায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এসে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাত সদস্যের একটি গবেষক দলের জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গবেষক দলটি টানা ৬দিন জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ জরিপ চালায়। পরে তারা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়।

আইইডিসিআরের জরিপ অনুযায়ী, বরগুনা পৌরসভার প্রধান দুটি ওয়ার্ডে, অর্থাৎ ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৮০শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। শহরের প্রতি ১০০টি বাড়ির বিপরীতে গড়ে ১৬৩টি লার্ভা প্রজননের স্থান রয়েছে। জমে থাকা পরিষ্কার পানিই লার্ভা উৎপাদনের মূল কারণ। জরিপে আরো উঠে এসেছে, একতলা ও ঝুপড়ি ঘরে মশার লার্ভা বেশি মিলেছে। সংগ্রহ করা ৫২২টি মশার মধ্যে ৫৮ শতাংশই ছিল বাইরের পরিবেশে জন্ম নেওয়া এডিস অ্যালবোপিকটাস আর বাকি ৪২শতাংশ ঘরের ভেতরে জন্মানো এডিস ইজিপ্টাই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো এলাকায় হাউস ইনডেক্স ১০শতাংশের বেশি হলে সেটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বরগুনা পৌর এলাকার ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সেই হার ৮০শতাংশ ছাড়িয়েছে। শুধু শহরেই নয়, সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এ ইউনিয়নের ৪৬টি বাড়ির মধ্যে ৩৫টিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এখানে ১৩১টি পানির পাত্রের মধ্যে ৭৫টিতে মশার বংশবিস্তার লক্ষ করা গেছে। এ ইউনিয়নে প্রজননের হার শহরের তুলনায় বেশি।

এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের গবেষক দলের প্রধান ডা. মো. তারিকুল ইসলাম লিমন বলেন, অনুসন্ধানকালে আমরা বরগুনা পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ড, বিভিন্ন আক্রান্ত এলাকা এবং জেলার প্রতিটি উপজেলা পরিদর্শন করেছি। এসব স্থান থেকে আমরা পানির ও মশার নমুনা সংগ্রহ করেছি। ২৫০শয্যাবিশিষ্ট বরগুনা জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও ‘সাসপেক্টেড’ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করি। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি।

তারিকুল ইসলাম বলেন, অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে, সেটি অত্যন্ত ভয়াবহ ও উদ্বেগের ব্যাপার। প্রায় প্রতিটি বাসায় রক্ষিত ফুলের টব, বাথরুমে ব্যবহৃত বালতি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাত্রসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাড়ির উন্মুক্ত স্থানে জমে থাকা পানিতেও মিলেছে এডিস মশার লার্ভা। মূলত এসব থেকে এডিস মশার জন্ম হয়েছে এবং ব্যাপক হারে ডেঙ্গু রোগ সংক্রমিত হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, অনেকটা অবচেতন মনেই এখানকার প্রতিটি বাসাবাড়িতে এডিস মশার চাষ করা হচ্ছে।

এর জন্য এলাকার বাসিন্দাদের উদাসীনতাকে দায়ী করেছে গবেষক দল। ডা. তারিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ওইসব বাড়ির বাসিন্দাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি কীভাবে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দুদিন পর সেসব বাড়িতে আবার গিয়ে একই অবস্থা লক্ষ করা গেছে।

আইইডিসিআরের গবেষক দলের মতে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কোনোভাবেই প্রশাসনসহ কারো পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

এদিকে বরগুনা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২৪ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে আরো ৭৭ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জানুয়ারি থেকে ৩০জুন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৯৩২জনে। বর্তমানে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বরগুনা জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছেন ২২২জন। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন দুই হাজার ৭১০জন। সরকারি হিসাবে জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বরগুনায় মারা গেছেন ছয়জন। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৭জন। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে ধারণা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

জানতে চাইলে বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সীমা এখন চূড়ায় অবস্থান করছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে বরগুনাবাসীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, শুরুতে প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষ সচেতন হলে হয়তো এ পরিস্থিতি এড়ানো যেত। বর্তমানে পৌরসভা ও প্রশাসন মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিয়েছে। এতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে এখন যে অবস্থা, তাতে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।

এদিকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে বরগুনা পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বরগুনা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় ফগার মেশিন ও কীটনাশক দিয়ে নিয়মিত মশা নিধনে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সমন্বয়ে এসব কাজ করা হচ্ছে।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, আইইডিসিআরের পরামর্শ অনুযায়ী বরগুনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু নির্মূলে নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নিজস্ব তহবিল থেকে মশক নিধনের ওষুধ কিনে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে মশার উৎপাদন ও বিস্তার এবং বৃষ্টির পানিসহ পানি সংরক্ষণের বিষয়টি যাতে ঝুঁকিমুক্ত হয়, সে ব্যাপারে হাতে-কলমে বোঝানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান।

সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক


শেয়ার করতে ক্লিক করুন:

Explore More Districts