ভূমিকা
সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র—এই তিন স্তম্ভ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু যখন এদের চালনার রশিতে গিঁথে যায় এমন সব শব্দ, যেগুলোর জন্ম লোভ, অন্যায় ও বিবেকহীনতার গর্ভে—তখন শুধু শব্দ নয়, গোটা সমাজব্যবস্থা হয়ে পড়ে অচল, অমানবিক এবং আত্মবিধ্বংসী।
আজ আমরা যেসব শব্দের কথা বলছি—সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, পেশিশক্তি, গীবত, মিথ্যাচার, লোভ, হীনমন্যতা—এসব কেবল শব্দ নয়, মানুষের এক একটি নৈতিক পরাজয়ের চিহ্ন। এগুলোর উৎপত্তি ইতিহাস, ধর্ম, সমাজতত্ত্ব এবং মনস্তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—মানবতার যে উত্তরণ হবার কথা ছিল, তা কোথায় আটকে গেছে।
এই শব্দগুলোর উৎপত্তির উৎস কী?
ক্ষমতা ও অপব্যবহার:
ইতিহাসের শুরু থেকেই ক্ষমতা একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি। কিন্তু যখন তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তখনই আসে অপব্যবহার। প্রাচীন শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ‘দেবত্ব’ দাবি, আধুনিক আমলে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে ‘ক্ষমতার বানিজ্য’—সবখানেই রয়েছে একই মনোবৃত্তির প্রতিফলন।
সুদ ও ঘুষ:
অর্থনৈতিক বৈষম্যের সুযোগে এক শ্রেণি যখন অন্যদের দুর্বলতা ও প্রয়োজনকে পুঁজি করে লাভবান হয়, তখন গড়ে ওঠে সুদ প্রথা। ঘুষ, তারই প্রশাসনিক রূপ। এটি মূলত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফসল।
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি:
ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ যখন প্রতিষ্ঠা পায়, তখন জন্ম নেয় দুর্নীতি। এর পেছনে কাজ করে আত্মীয়কেন্দ্রিক মানসিকতা ও আত্মস্বার্থ।
গীবত, অপবাদ ও মিথ্যাচার:
সামাজিক প্রতিযোগিতা এবং ঈর্ষা থেকে মানুষ কখনো ইচ্ছাকৃত, কখনো অজান্তেই গীবত ও অপবাদ দেয়। এই কাজগুলো মানুষকে মানসিকভাবে নীচে নামিয়ে দেয় এবং সম্পর্ক ধ্বংস করে।
লোভ, হীনমন্যতা ও অপশক্তি:
আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, আত্মসচেতনতার অভাব, এবং বৈষয়িক সাফল্যের অন্ধ মোহ মানুষকে লোভী করে তোলে। তখনই সে অপশক্তির বাহক হয়ে ওঠে।
এসব আচরণের সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্রে কী ক্ষতি হয়?
০১. পরিবারে:
বিশ্বাসের ঘাটতি ও সংঘাত তৈরি হয় , সন্তানদের মনে গড়ে ওঠে নৈতিক দ্বিধা, পারিবারিক ঐক্য ভেঙে পড়ে,
০২. সমাজে:
সামাজিক অবিচার ও বৈষম্য বাড়ে, অরাজকতা ও পেশিশক্তির ভয় জন্ম নেয়, প্রতিভা নয়, ‘চাকরি পাই ঘুষ দিয়ে’ সংস্কৃতি তৈরি হয়।
০৩. রাষ্ট্রে:
প্রশাসন হয় দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত, আইনের শাসন হয় কাগুজে, জনসাধারণের আস্থা রাষ্ট্র থেকে উঠে যায়,
মানুষ কেন এসব করে? (একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা)
ভয়ের কারণে: জীবনের নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে চাতুর্যে উদ্বুদ্ধ করে, পরিবেশ ও সংস্কার: পরিবারে বা সমাজে যদি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তা স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে মানুষ, লোভ ও স্বার্থপরতা: দ্রুত সাফল্যের মোহ, প্রতিযোগিতার চাপ মানুষকে সহজ পথ বেছে নিতে বাধ্য করে।
সমাধানের পথ কী?
০১. আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি
প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করুন: “আজ আমি কী অন্যায় করেছি?” ভুলকে স্বীকার করতে শিখুন।
০২. শিক্ষা ও মূল্যবোধ চর্চা
শিক্ষা শুধু ডিগ্রি নয়, নৈতিকতা শেখানো জরুরি, ঘরে ও স্কুলে সত্যবাদিতা, সহমর্মিতা, বিচারবোধ গড়ে তুলতে হবে।
০৩. আইন ও সামাজিক ন্যায়
কঠোর ও নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগ করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন,
০৪. আদর্শ মানুষ ও রোল মডেল তৈরি
সমাজে যারা নৈতিকভাবে জীবন যাপন করছে, তাদের তুলে ধরুন, মিডিয়া, সাহিত্য, থিয়েটারে সততা ও কল্যাণের গল্প প্রচার করতে হবে।
শেষ কথা: আমরা কী সত্যিই পরিবর্তন চাই?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ও আত্মিক স্তরে যেতে হবে। সমাজের পরিবর্তন শুরু হয় একটি মানুষের বিবেক থেকে। আজ আপনি নিজে যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তাহলে আগামীকাল আরেকজন অনুপ্রাণিত হবে।
পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব নয়, প্রয়োজন নীরব বিবেকের জাগরণ। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে যদি সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলো জ্বলে ওঠে—তবে এসব শব্দ একদিন শুধুই অভিধানের পৃষ্ঠা হয়ে থাকবে, জীবনের নয়।
কাজী হাফিজুর রহমান, সম্পাদক, নড়াইলকণ্ঠ (সাপ্তাহিক ও অনলাইন সংস্করণ)