⛓️ বিভেদের শিকড় কোথায়?
বিভাজনের এই ধারাটি প্রাকৃতিক নয়, এটি সমাজ-নির্মিত এবং বহু প্রজন্ম ধরে চর্চিত। মানুষের গায়ের রং, ভাষা, ধর্ম, জাতি, গোত্র, অর্থনৈতিক অবস্থা—এই সব উপাদানই ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপ নেয়। কেউ হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কেউ সংখ্যালঘু। কেউ উচ্চবর্ণ, কেউ নিম্নবর্ণ। কেউ নগরের অভিজাত, কেউ গ্রামবাংলার অবহেলিত। প্রশ্ন জাগে—এই শ্রেণিবিভক্তির দায়ভার কার?
বর্ণবাদের জন্ম এক প্রকার শ্রেষ্ঠত্ববাদের মধ্যে নিহিত। একদল মানুষ ভাবতে শুরু করে তারাই সেরা—ধর্মে, জাতিতে, সংস্কৃতিতে, জ্ঞানে কিংবা অর্থে। এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিই জন্ম দেয় বৈষম্যের। এবং সেখান থেকেই শুরু হয় রাজনীতি।
🏛️ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি-রাজনীতির রসদ
ধর্ম কিংবা জাতি একসময় ছিল আত্মপরিচয়ের উপাদান। কিন্তু আধুনিক সমাজে এগুলোকে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি, গোষ্ঠীভিত্তিক ভোটের রাজনীতি কিংবা জাতিগত বিদ্বেষ—সবই মূলত ক্ষমতা দখলের কৌশল।
একটি রাষ্ট্রে ধনী, শিক্ষিত ও ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় সেবাগুলো নিজেদের দিকে কেন্দ্রীভূত করতে থাকে। অন্যদিকে, গরিব এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের মূলস্রোত থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ন্যায্য বিচার—সবকিছুতেই তারা পিছিয়ে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে তাদের মেধার বিকাশ থেমে যায়, তারা হয়ে ওঠে সমাজের বোঝা। অথচ অপরপক্ষে—ধনবান শ্রেণিটি হয়ে ওঠে ‘যোগ্য নেতৃত্বের’ দাবিদার!
⚖️ বঞ্চনার পরিণতি কী?
এই দীর্ঘদিনের বৈষম্য সমাজে সৃষ্টি করে হিংসা, বিদ্বেষ, অপরাধ এবং মেধার অপচয়। বঞ্চিত জনগোষ্ঠী যখন দেখে রাষ্ট্র তাদের পাশে নেই, তখন তারা হয়তো মাদক, চুরি, সহিংসতা কিংবা মৌলবাদিতার পথ বেছে নেয়। সমাজের এই অংশকে ‘অযোগ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মূল শ্রেণিটি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে আরও জোরদার করে। শুরু হয় বঞ্চিতদের উপর আরেক দফা নিপীড়ন—প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন কিংবা মিডিয়ার মাধ্যমে।
পরিত্রাণের পথ: মানবিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন
এখানেই প্রশ্ন-উপায় কী?
মানুষের প্রকৃত পরিচয় হলো তার মানবতা, বিবেক, ও নৈতিকতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ কিংবা শ্রেণি নয়। রাষ্ট্র যদি চায় সকল নাগরিকের সমান বিকাশ ও অংশগ্রহণ, তবে প্রথম কাজ হবে—ভিন্নতা নয়, সমতার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন।
মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করা, ইতিহাস ও মনুষ্যত্বভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, এবং রাষ্ট্রের সম্পদ ন্যায্যভাবে বণ্টনের মধ্য দিয়েই এই দুর্যোগ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
🕊️ শেষ কথা: মানুষ হই আগে, তারপর অন্য পরিচয়
জন্মের পর একজন শিশু যেমন জানে না সে কার ঘরে এসেছে, তেমনি মৃত্যুর পর কোনো ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণি তার পাশে থাকে না। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষ হিসেবে মানুষকে সম্মান করা, সহযোগিতা করা, ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া—এই তো আসল দায়িত্ব।
পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা যেমন দরকার, তেমনি ব্যক্তির মানসিক বিপ্লবও প্রয়োজন। একজন সচেতন মানুষ, একজন সৎ রাজনীতিক, একজন মানবিক নাগরিক সমাজের কাঠামো পাল্টে দিতে পারে।
তাই প্রশ্ন নয়, আজ আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে-আমি কি মানুষ হয়ে বাঁচবো, না পরিচয়ের মোড়কে আরেকজনকে ছোট করেই সমাজের আরেক বঞ্চকের অংশ হবো?