চাঁদপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী জনপদের নাম হাজীগঞ্জ। এখানকার জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ বর্তমানে মুসলমান। নদীমাতৃক পলিমাটির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে হাজীগঞ্জ জনপদ।
হাজীগঞ্জ উপজেলার অন্যতম প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ। এটি বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন, বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন, আহমাদ আলী পাটওয়ারী ওয়াকফ এস্টেটের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। কালের বিবর্তনে মসজিদটি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
চাঁদপুর জেলাবাসীর প্রাণপ্রিয় এবং প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের এ গৌরবােজ্জ্বল ও অনন্য প্রতিষ্ঠানটি আল্লাহর অলীগণের রুহানী ফয়েজ ও বরকতে শিরক-বিদাত মুক্ত ‘এবাদতের মারকাজ’ হিসেবে খ্যাত। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের কারামত, ও ফয়েজ-বরকতে ‘পূণ্যভূমি হাজীগঞ্জ’ আজ ধন্য এবং গৌরবান্বিত।
তাছাড়াও উক্ত প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ আরও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ শুভাগমন করেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য-– শায়খুল ইসলাম আল্লামা হােসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.), আল্লামা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.), আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.), আল্লামা আতহার আলী (রহ.), আল্লামা এহতেশামুল হক থানভী (রহ.) সহ আরও বহু হক্কানী পীর মাশায়েখ এবং শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীন।
উক্ত প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ হিসেবে উল্লেখ্য যে, বাংলা এগার’শ পঁচাত্তর থেকে বার’শ সালের মধ্যে হযরত মকিমউদ্দিন (রহ.) নামে একজন বুজুর্গ অলীয়ে কামেল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পবিত্র আরবভূমি থেকে অত্র এলাকায় আগমন করেছিলেন। তিনি সপরিবারে বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাব সংলগ্নস্থান, যেখানে একটু উঁচুভূমি বিদ্যমান ছিল,সেখানে আস্তানা এবং বসতি স্থাপন করেন।
তাঁর প্রজ্ঞা,জ্ঞান ও চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বহু লােক তার কাছে দীক্ষা নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। এ এলাকায় হাজী মকিমউদ্দিন (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের মাধমে ইসলামের আবাদ করেন। সে কারণে তাঁর নামের সাথে মিলিয়ে তাঁর স্মরণে এলাকার নামকরণ হয় ‘মকিমাবাদ’।
তার মৃত্যুর পর তাকে তার বসত বাড়িতেই সমাহিত করা হয়। তারই বংশের শেষ পুরুষ হযরত মনিরুদ্দিন হাজী ওরফে মনাই হাজী (রহ.) সুন্নাতে রাসূল (সা.) হিসেবে এ এলাকার জনসাধারণের ব্যবহার্য চাল, ডাল, তেল, লবণ ইত্যাদি নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর একটি দোকান বর্তমান মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র মাজার সংলগ্ন একটু পূর্বাংশে পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত নালা-খালের উত্তরে স্থাপন করেন।
তাঁর সেই দোকানটি হাজী সাহেবের ‘হাজী দোকান’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। হাজী দোকান থেকে পর্যায়ক্রমে হাজীর হাট গড়ে ওঠে এবং উক্ত হাজীর হাটে দূর-দূরান্ত থেকে আগত গুটিকতেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান চৌধুরী ঘাটের পরিবর্তে হোগলা হাটে নামাজ আদায় করতেন। সে সময় বর্তমান বাজার এলাকার মধ্যে হযরত মনিরুদ্দিন (রহ.)’র পূর্ব পুরুষের পৈত্রিক ভূমির আবাসস্থল ব্যতিত আর কোনো ভূমি স্থায়ীভাবে ছিলনা।
মনাই হাজী (রহ.)’র ওফাতের পর তাঁর পূর্ব পুরুষগণের সাথে তাকেও পৈত্রিক বাড়ি তথা বর্তমান মসজিদের কবরস্থানে সমহিত করা হয়। সকলের প্রাণপ্রিয় মনাই হাজী (রহ.)’র হাজী দোকানের সুখ্যাতিতে আরও কিছু দোকান বর্তমান মসজিদ এলাকায় গড়ে উঠে, যা কালক্রমে প্রসার লাভ করে এক পর্যায়ে ‘হাজীর হাট’ থেকে ‘হাজীর বাজার এবং কালক্রমে ‘হাজীগঞ্জ বাজার’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
হাজীগঞ্জের হাজী মনাই হাজী (রহ.)’র দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) বাংলা তেরশ পঁচিশ থেকে ত্রিশ সালের দিকে বড় মসজিদের মেহরাব বা তৎসংলগ্ন স্থান জুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা অতঃপর খড় এবং গােলপাতা দিয়ে তৈরী দোচালা মসজিদ নির্মাণ করেন। যা পরবর্তীতে টিনের দোচালা মসজিদ থেকে পাকা মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
পরম করুনাময় আল্লাহ্পাকের অশেষ মেহেরবানীতে শরীর, মনােবল এবং প্রচণ্ড মেধাশক্তির অধিকারী আহমাদ আলী পাটওয়ারী আল্লাহর উপর ভরসা করে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া তথা ধনাঢ্য পিতার সম্পদ-সম্পত্তি এবং পরম শ্রদ্ধেয় নানা মনাই হাজী (রহ.)’র উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্ত সকল সম্পদ-সম্পত্তি দেখা-শুনার পাশাপাশি নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা হিসেবে মসজিদের কাজে গুরুত্ব প্রদান করেন।
১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র পরম ইচ্ছায় হযরত মাও. আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.)’র পবিত্র হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদখানা তিন অংশে নির্মিত হয়েছে।
প্রথম অংশ ৪৭৮৪ বর্গফুট, মাঝের অংশ ১৩০০৬ বর্গ ফুট এবং তৃতীয় অংশে ১৬১৫ বর্গ ফুট। সর্বমােট ২৮৪০৫ বর্গফুট আয়তনের উক্ত মসজিদে প্রথম অংশে হযরত মাও: আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) ভারী শরীর নিয়ে, মাচার উপর বসে, তার পবিত্র হাতে চুন-সুরকির মসলা কেটে কেটে অনেক কষ্ট করে মেহরাব সংলগ্ন দেয়াল ঘুরিয়ে মসজিদের প্রথম অংশের উপরের দিকে ‘সুরা ইয়াছিন’ ও ‘সুরা জুময়া লিপিবদ্ধ করেন।
বর্তমান সময়ে সংস্কারকালে তা উঠিয়ে মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়। উক্ত মসজিদের অনন্য সুন্দর মেহরাবটি কাচের ঝাড়ের টুকরাে নিখুতভাবে কেটে কেটে মনােরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় নক্শায় সাজিয়ে তােলা হয়েছে।
মাঝের অংশটি ৭৭ টি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মুজাইক দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। তৃতীয় অংশটিতে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজসহ আকর্ষণীয় বিশাল সুউচ্চ মিনার। ১৯৫৩ সনে সু-উচ্চ এই মিনারটি তৈরি হয়েছিল। মিনারের উঁচু প্লাটফর্মে বহু মুসল্লি ও পর্যটক উঠে হাজীগঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলােকন করেন। প্রতিদিন মিনারের উচু থেকে একযােগে মাইক দিয়ে আজান প্রচার করা হয়। বহুদূর দূরান্ত থেকে এ আজানের ধ্বনি শােনা যায়।
কারুকার্যখচিত মসজিদের সর্বশেষ পূর্ব প্রাচীরে পবিত্র কালেমা শরীফ খচিত চিনা বাসনের টুকরাে দিয়ে তৈরি মনােরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় করে সাজানাে বিশাল ফটক। মসজিদে প্রবেশের সুবিশাল ফটকের আকর্ষণীয় সাজ দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়। পাথরের সাজে সজ্জিত অসংখ্য তারকাখচিত তিনটি বড় বড় গম্বুজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ:) এর উদ্যোগে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পরপরই কোরআনী শাসনের দাবীতে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ প্রাঙ্গনে এক বিরাট ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের এন্তেজামিয়া কমিটির সভাপতি ছিলেন রূপসার জমিদার সৈয়দ আবদার রশিদ সাহেব। বিভিন্ন শাখার সভাপতি থাকেন মাওলানা জাফর আহমাদ ওসমানী থানভী (রহ.),মাওলানা আব্দুল হাই কোরাইশী (রহ.) শর্ষিনা, মাওলানা আবু জাফর ছিদ্দিকী (রহ.) আল-কোরাইশী ফুরফুরা শরীফ, যােগাযােগ সচিব থাকেন মাওলানা হাতেম (রহ.) সাহেব নােয়াখালী। পাক ভারতের খ্যাতনামা ওলামায়ে কেরাম এই সম্মেলনে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদে তাশরিফ আনেন। সম্মেলন সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মূল সম্মেলনের সভাপতি আল্লামা মাওলানা হাকিম মাে. আব্দুর রউফ দানাপুরী (রহঃ) পাকিস্তানে ইসলামী আদর্শভিত্তিক শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্যে কোরআন ও সুন্নাহ’র পুরােপুরি বাস্তবায়নের উপর সুদীর্ঘ ভাষণ দান করেন। তার ভাষণের অনুলীপি কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল। আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানীতে প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় সম্মেলন উক্ত মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ প্রতি জুময়ার নামাজ এবং পবিত্র রমজান মাসের জুমাতুল বিদার নামাজে প্রায় লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগম ঘটে। তখন আশে-পাশের রাস্তাঘাট, ভবন এবং ভবনের ছাদসহ পুরো বাজার এলাকা মসজিদে পরিণত হয়ে যায়। বিশাল এ মসজিদে রয়েছে মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা।
পবিত্র মাহে রমজান মাসে ইফতার এবং সেহেরীর সময় সম্পর্কে মুসলমানগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে সুদূর সৌদি আরব থেকে সাইরেন আনা হয়; সেই ধারাবাহিকতায় আজও সে ব্যবস্থাপনা অব্যাহত রয়েছে। হাজীগঞ্জ বাজারে বহুমাত্রিক ব্যবসায়ী সৃষ্টির লক্ষ্যে আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র অবদান অনস্বীকার্য।
তিনি বিভিন্ন ধরণের ছােট ও মাঝারি ব্যবসায়ী গড়ে তােলার পাশাপাশি এলােপ্যাথিক ডাক্তার, হােমিওপ্যাথিক ডাক্তার, আয়ুর্বেদী-শাস্ত্রীয় ঔষধের দোকান বসানাে এবং সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এমনকি তিনি কোনাে কোনাে ব্যবসায়ীকে ব্যবসায়ের জন্য চালান বা নগদ টাকা প্রদান করেছেন। সে সময় হাজীগঞ্জ বাজারে বিদ্যুৎ ছিল না।
তিনি জেনারেটর বসিয়ে নিজ বাড়িসহ মসজিদে বৈদ্যুতিক পাখা এবং আলোর পাশাপাশি বাজারে। বৈদ্যুতিক আলাে-বাতির ব্যবস্থা করেন। হাজীগঞ্জ বাজারের সমৃদ্ধি পুরাে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে দূর দুরান্তের লােকজন হাজীগঞ্জ বাজারমূখী হতে উৎসাহিত হন।
এভাবে আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি হাজীগঞ্জ বাজারের সমৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) মেহরাব থেকে মিনার পর্যন্ত ২৮৪০৫ বর্গফুট আয়তনের এই বিশাল মসজিদটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুসল্লিগণের ইবাদতের সুবিধার্থে আর্থিক সমস্যা কিছুটা হলেও ঘুচানাের লক্ষ্যে স্থায়ী আয়ের। উৎস হিসেবে সম্পদ-সম্পত্তি এবং দোকানঘরের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করেন। মসজিদ সংলগ্ন জায়গায় ধর্মশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে স্থাপন করা হয়েছে মাদ্রাসা ও এতিমখানা তথা ধর্মীয় এবং মানবকল্যাণমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসাগুলােতে আবাসিক ও অনাবাসিক উভয় প্রকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের সুযােগ রয়েছে। দরিদ্র, এতিম, দুস্ত ও অসহায় শিক্ষার্থীরা দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে আহমাদিয়া কামিল মাদ্রাসা, মুনিরিয়া নূরানী মাদ্রাসা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বাের্ডিং, দুস্ত অসহায়দের সহযােগিতা প্রদান, বয়স্কদের জন্য পবিত্র কোনআন মাজিদ শিক্ষা কার্যক্রম, মহিলাদের জন্য প্রতি মাসে ধর্মীয় দিক সম্পর্কে আলােচনামূলক অনুষ্ঠান, স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য নূরানী পদ্ধতিতে কোরআন শিক্ষার কার্যক্রম এবং ধর্মীয় দিবসে ওয়াজ ও দোয়া মাহফিলের ব্যবস্থা।
ধর্ম-কর্ম, শিক্ষা-দিক্ষা, বিনিয়ােগকর্মসংস্থান এবং গণমানুষের সেবার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদটি কালের বিবর্তনে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ হিসেবে মানুষের মনে দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলাের অন্যতম হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
জেলাবাসী ধন্য হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের জন্য। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি সরকার কিংবা কোনাে রাজা বাদশাহ, জমিদার কর্তৃক নয় বরং সততার অনন্য প্রতীক, বিরল ব্যক্তিত্ব ও নিরলস কর্মবীর, নিবেদিতপ্রাণ, প্রচণ্ড মেধাশক্তি সম্পন্ন, অলীয়ে কামেল হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র কর্মকুশলতায় নির্মিত হয়েছে।
আখেরাতের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের সম্পদ-সম্পত্তি ও দান-অনুদানসহ উন্নয়ন কার্যক্রমে আত্ম নিয়ােগ করেন। তাঁর অবদানের পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিগণের নিয়ত-মানত ও দানের অর্থে বিশাল কমপ্লেক্সের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে আহমাদ আলী (রহ.)’র সুযােগ্য নাতি অধ্যক্ষ ড. আলমগীর কবির পাটওয়ারী সততা ও নিষ্ঠার সাথে তার উপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপেক্স এর ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য কণিকা-১ : ১. যে সময় পূর্ব বাংলায় কোটি লােকের বসবাস ছিলনা বললেই চলে, সে সময় আহমাদ আলী পাটওয়ারী (র:) হাজীগঞ্জের অজপাড়া গাঁয়ের প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে, উত্তরে দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিশাল এক মসজিদ তৈরি করে সমগ্র বাংলায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
২। আহমাদ আলী পাটওয়ারী (র:) নিজ সম্পত্তিতে বাড়ী ঘর না করে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। ওয়াকফ কৃত প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে তিনি তার সাধ্যমত সর্ব সাধারণের সেবার মান রক্ষার জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। ৩। রাজা বাদশা নয় একজন আলাহ প্রেমিক, আলাহ ভক্ত দ্বীনদার আল্লাহর অলি আহমাদ আলী পাটওয়ারী (র:) ২৮ হাজার বর্গফুট আয়তনের বর্তমান মসজিদের মেহরাব থেকে মিনার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করে স্মরণীয় এবং বরণীয় হয়ে আছেন।
৪। তিনি জ্ঞানী মুসুল্লী তথা ইমান আকিদায় দীপ্ত মুসলমান তৈরীর লক্ষ্যে প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সুতিকাগার হিসেবে দুই ধরনের দ্বীনি মাদ্রাসার জন্য সম্পত্তি ওয়াকফ করেন এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে অত্র এলাকায় দ্বীনি শিক্ষার সুচনা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য কণিকা -২ : ১। হাজীগঞ্জ মসজিদে জুময়ার নামাজের আজান ও একামাতের উদ্বোধনী দিবসে অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রীসহ মোট ৪ জন মন্ত্রীর একত্রে উপস্থিতিপূর্বক পবিত্র নামাজ আদায় এক বিরল দৃষ্টান্ত।
যা এ মসজিদকে ঐতিহাসিক মর্যাদায় সমাসীন করেছে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে সকল স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব এ মসজিদে আগমন করেন তারা হলেন তদানীন্তন মন্ত্রীবর্গ সর্বজনাবক) শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক (অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী); খ) হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী ; গ) নওয়াব মোশারফ হােসেন ; ঘ) নওয়াব জাদা খাজা নসরুল্লাহ ।
ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য কণিকা -৩ : এ মসজিদে শুভাগমন করে নামাজ আদায় করেছেন স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিশেষভাবে উলেখযােগ্য এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইতিহাস খ্যাত অতি গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব। ক) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খ) মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সহ আরাে অনেকে। ইতিহাস প্রশিদ্ধ এসকল বিশ্ব মানের ব্যক্তিত্ব বড় মসজিদ পরিদর্শন এবং নামাজ আদায় করে হাজীগঞ্জ মসজিদকে ঐতিহাসিক মর্যাদায় সমাসীন করেন।

প্রতীকী ছবি
ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য কণিকা-৪ : যে সকল আউলিয়া কেরাম ইসলামের আলাে জ্বালাতে অত্র এলাকায় আগমন করেছেন। এলাকায় হেদায়াতের বাণী প্রচার করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ১. হযরত মকিমউদ্দিন (র:) ২. হযরত মতিউদ্দিন (র:)। ৩. হযরত মনিরুদ্দিন (মনাই হাজী) র: ৪. আল্লামা হযরত মাও. হাকিম আব্দুর রউফ দানাপুরী (র:)
৫. আল্লামা হযরত মাও. হােসাইন আহমাদ মাদানী(র:) ৬. আল্লামা হযরত মাও. জাফর আহমদ উসমানী (র:) ৭. আল্লামা হযরত মাও. আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরাইশি (র:) ৮. আল্লামা হযরত মাও. ইউসুফ মক্কী (র:) তাঁদের অবদানে বড় মসজিদ ঐতিহাসিক মর্যাদায় গৌরবাহ্নিত হয়েছে।
ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য কণিকা-৫ : বৃটিশ শাসনের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে পর তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ- তৎকালিন দু পাকিস্তানের মধ্যে ইসলামী হুকুমতের দাবিতে ৭ দিনব্যাপি ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় হাজীগঞ্জ মসজিদে। যা হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা। উক্ত সম্মেলন এন্তেজামিয়া কমিটির সভাপতি ছিলেন রুপসার জমিদার সৈয়দ আবদার রশিদ সাহেব। সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন-মরহুম খান সাহেব আমিন মিয়া।
সহকারী সম্পাদক ছিলেন আলহাজ্ব হযরত মাও. আশরাফুদ্দিন আহমদ চিশতী। স্বেচ্ছাসেবকের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন- মরহুম আব্দুর রব মিয়া এম. পি.। মূল সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন- আল্লামা মাও. হাকীম আব্দুর রউফ দানাপুরী সাহেব। বিভিন্ন শাখার সভাপতি মাও. জাফর আহমাদ উসমানী থানভী (রহ.), মাও.আব্দুল হাই কোরাইশী (রহ.) ছারছীনা, মাও. আবু জাফর ছিদ্দিকী (রহ.) আল-কোরাইশী ফুরফুরা শরীফ, সচিব- হযরত মাও. হাতেম সাহেব (রহ.) নােয়াখালী। সভাপতি আল্লামা মাও. হাকিম মাে.আব্দুর রউফ দানাপুরী (রহ:) পাকিস্তানে ইসলামী আদর্শভিত্তিক শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনে কোরআন ও সুন্নাহর পুরোপুরি বাস্তবায়নের উপর উর্দু ভাষায় সুদীর্ঘ ভাষন দান করলেন।
তার ভাষণের অনুলিপি কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নিকট প্রেরণ করা হয়। উক্ত সম্মেলন উপলক্ষে ফুরফুরা শরীফের আলা হযরত মাও. আবু বকর ছিদ্দিকী আল-কুরাইশী, মোজাদ্দেদে জামান মাও. রুহুল আমিন (রহ:), মাও. আহমাদ মাদানী (রহ.), শাইখুল হিন্দ মাও. হামেদ (রহ:)ইবনে মাও. আব্দুল লতিফ (রহ:) সন্দীপী প্রমুখ সাহেবান তাসরিফ আনেন।
ইতিহাস ঐতিহ্যের তথ্য কণিকা-৬ : বড় মসজিদে ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে সকল আউলিয়ায়ে কেরাম তাশরিফ এনেছেন এবং উক্ত মসজিদকে ইতিহাস প্রশিদ্ধ ধর্মীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ আউলিয়া কেরামগণের দোয়ার বরকতময় মারকাজ হিসেবে ঐতিহাসিক মর্যাদায় গৌরবান্বিত করেছেন।
তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন : ১. আলল্লামা হযরত মাও. হাকিম আব্দুর রউফ দানাপুরী (র.) ২. আল্লামা হযরত মাও. হোসাসাইন আহমাদ মাদানী(র:) ৩. আল্লামা হযরত মাও. জাফর আহমদ উসমানী (র:)
৪. আল্লামা হযরত মাও. আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরাইশি (র:) ০৫. আল্লামা হযরত মাও. হক থানবী (র:) ৬. আল্লামা হযরত মাও. আতহার আলী (র:) ৭. আল্লামা হযরত মাও. তাজুল ইসলাম ফখরে বাঙ্গাল (র:) ৮. আল্লামা হযরত মাও. মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (র:) ৯. আল্লামা হযরত মাও. আব্দুল হাই সিদ্দিকী আল-কুরাইশী (র:) ১০. আল্লামা হযরত মাও. আবু জাফর সিদ্দিকী আল-কোরাইশী (রঃ)
১১. আল্লামা হযরত মাও. হাতেম আলী(র:) ১২. আল্লামা হযরত মাও. রুহুল আমিন (র:) ১৩. আল্লামা হযরত মাও. হামেদ ইবনে আব্দুল লতিফ (র:), ১৪. আল্লামা হযরত মাও. ইউসুফ মক্কী(র:), ১৫. আল্লামা হযরত মাও. হাফেজ আহমাদ (র:), ১৬. আল্লামা হযরত মাও. কারী ইব্রাহীম (র:), উজানী, ১৭. আল্লামা হযরত মাও. হাফেজ আব্দুর রব (র:), ১৮. আল্লামা হযরত মাও. ওজিহউল্লাহ সন্ধিপী (র:), ১৯. আল্লামা হযরত মাও. সৈয়দ আব্দুল করিম মাদানী(র:),
২০. আল্লামা হযরত মাও. সৈয়দ ইসহাক (র:) চরমােনাই, ২১. আল্লামা হযরত মাও. নেছার উদ্দিন (র:), ছারছীনা , ২২. আল্লামা হযরত মাও. আবুল আনছার আব্দুল কাহ্হার সিদ্দিকী (র:), ২৩. আল্লামা হযরত মাও. আব্দুল জব্বার (র:), বাইতুশ শরফ, ২৪. আল্লামা হযরত মাও. সৈয়দ ফজলুল করিম (র:), চরমােনাই, ২৫, আল্লামা হযরত মাও. আব্দুর রহমান (র:), সোনাকান্দা, ২৬. আল্লামা হযরত মাও. হাবিবুর রহমান খায়রাবাদী, দা. বা. দেওবন্দ , ২৭. আল্লামা হযরত মাও. শাহ আহমাদ শফি, দা: বা: হাটহাজারী, ২৮. মূহীউসসুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দা. বা. ও ২৯. আলামা নাসির বিলাহ মক্কী (দা: বা:)। (বাকি অংশ পরবর্তী সংখ্যায়) ।
তথ্য সূত্র : হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স এর স্মারক গ্রন্থ । সম্পাদনা: আবদুল গনি, ভার-প্রাপ্ত সম্পাদক , সাপ্তাহিক হাজীগঞ্জ ।
১৭ জুন ২০২৫ ।