হুমায়ূন আহমেদের সব নাটকের শুটিংয়ে আমি যেতাম। এবারের নাটকে আমাদের ৩ নম্বর কন্যাও অভিনয় করছিল। এর মধ্যে ঈদে সবার জন্য যখন নতুন কাপড় কেনা হলো, তখন চতুর্থ কন্যা, রাত্রির জন্যও জামা কেনা হলো।
হুমায়ূন আহমেদকে ইউএসআইএস থেকে আমেরিকাতে তিন মাসের জন্য পাঠানো হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে লেখক আসবেন সেখানে। তাঁর পোশাক সাধারণত আমি কিনি। স্যুটকেসের দায়িত্ব নিয়েছেন মুনির ভাবি, তাঁরা নিউমার্কেটের খুব কাছে থাকেন (যদিও ‘মে ফ্লাওয়ার’, হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লেখায় ‘স্যুটকেস আমার কেনা’ লিখেছেন)।
হুমায়ূন আহমেদ তখন খুবই ব্যস্ত; কারণ, তিন মাসের নাটক লিখে, অভিনয় পর্বগুলো দেখে তিনি যাবেন। আমাকেও নাটক পড়ে দেখতে হবে আগের পর্বগুলোর রিপিটেশন যেন না থাকে।
আমার কন্যার জন্মের তারিখ পার হয়ে গেছে (প্রতিবারই এমন হয়), আমরা দুজনই ডাক্তারের কাছে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ডাক্তার সাহেব, আর কিছুদিন পরই আমি দেশের বাইরে যাব। আমি কি বাচ্চাকে দেখে যেতে পারব না? ডাক্তার সাহেব বললেন, কালকে সকাল ৮টার মধ্যে আমার ক্লিনিকে চলে আসবেন।
তত দিনে একজন প্রকাশক লেখককে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আমি ৮টার অনেক আগেই রেডি। একটু পরপর বলছি, ৮টা প্রায় বেজে যাচ্ছে। অবশেষে আমরা ক্লিনিকে পৌঁছালাম ৮টা ৫ মিনিটে। ডাক্তারের নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পর! শুনলাম, উনি ঠিক ৮টায় চলে গেছেন। আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন নাটকের আউটডোর শুটিংয়ে। কয়েকজন অল্প বয়সী ডাক্তার এবং নার্স কিছুক্ষণ পরপর আমার পালস, হার্টবিট এবং বাচ্চার হার্টবিট চেক করছেন। সাড়ে ১১টার দিকে একজন ডিউটি ডাক্তার অথবা নার্স ডাক্তারকে ফোন করে বললেন, বাচ্চার হার্টবিট ইরেগুলার!
আমার সাথে আত্মীয়স্বজন কারা ছিলেন, কিছুই মনে পড়ছে না। কারণ, সকাল থেকেই আমার কিছু ভালো লাগছিল না! কেন যেন খুব মন খারাপ লাগছিল। শুনলাম, ডাক্তার সাহেব ২টা থেকে ৩টার মধ্যে এসে অপারেশন করবেন। উনি এলেন রাত ৯টার দিকে। ততক্ষণে হুমায়ূন আহমেদ আউটডোরের কাজ শেষ করে দলবল নিয়ে ক্লিনিকে চলে এসেছেন। এর পরের ঘটনা আমার তেমন মনে নেই, শুধু মনে আছে, আমাকে কেউ একজন ইনজেকশন দিয়েছেন।
মাঝরাতে মনে হলো, একটি পুরুষ কণ্ঠে কেউ বলছেন, এই যে শুনতে পাচ্ছেন? আপনার তো ছেলে হয়েছে! তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ি!
সকালে ঘুম ভাঙে, দেখি, চেয়ারে বসে আছেন লেখক সাহেব। আমার খুব কাছে এসে বললেন, ‘গুলতেকিন, তোমার তো রাজপুত্রের মতো ছেলে হয়েছে! কী চাও তুমি?’ আমি ক্লান্ত গলায় বলি, ‘কিছু না।’
‘তোমাকে খুব সুন্দর একটা ডায়মন্ডের আংটি কিনে দেব!’ আমি মনে মনে ভাবি, ‘ছেলে হলে কেন ডায়মন্ডের আংটি দেবে?’
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর একজন নামকরা ডাক্তার আমার পাশের চেয়ারে বসেন।
বলেন, ‘আপনি বোধ হয় শুনেছেন, আপনার ছেলে এমএএসে ভুগছে! আমরা একটি মেডিকেল বোর্ড তৈরি করেছি। কিন্তু আপনি তো তার “মা”, তাই আপনিও ওর কাছে বসে একটু দোয়া করেন!’
আমি কিছু না বুঝে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকি।

