২০১৮ সালে এইরকম একটি ঘরে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল! রাতের বেলা ২ দিন চোখ বেঁধে, দুই হাত পেছনে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে,মাঝেমধ্যে পায়ে বেড়ি দিয়ে গাড়ি করে বেশ কয়েকঘন্টা ছূটে বেড়িয়েছে।কোনো এক বেড়িবাঁধ এর কথা আমি অস্পষ্ট শুনেছিলাম! ওই সময় আন্দাজ করছি আরো ২ জন আমার সাথে ছিলো… আমাকে ইতোমধ্যে মেরে কাবু করে দিয়েছে তবুও দিনশেষে রাতে গাড়ি করে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আরেক গাড়িতে তুলে… সেই রাতেই তারা গালিগালাজ করছিলো, বলছিলো শুয়োরের বাচ্চারা কথা শুনেনা; এদের খেয়ে দেও। পরক্ষণেই সজোরে চড়- থাপ্পড় দিয়ে বললো, তোরা মারা খাবি। আজ শেষ দিন। ফায়ার করা হইব।একজন বললো, কলমা পইরা নে! তখন শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, আর বিপদমুক্তির দোয়া পড়ছিলাম৷ অনেক কষ্টে দাঁড়িয়েছিলাম এক জায়গায়…সে সময় মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। যতোবারই মেরেছে, লাত্থি দিয়েছে, বুকে পাড়া দিছে, নিতম্বে মারছিলো শুধু আল্লাহ, আল্লাহ, মা’ মা’ করছিলাম৷ কান্না করতে গিয়ে আর চোখে পানি আসছিলোনা! ঠোঁট কামড়িয়ে জিহবায় পানি খুঁজছিলাম!
(এই দোয়া দুরুদ আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর রুমের ভেতরে আগে থেকেই থাকা একজন হুজুরের কাছ থেকে শেখা… তাকে ২/৩ ঘন্টার মত পেয়েছিলাম… তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের নেতা ছিলেন। রুমে একরকম বিদ্ধস্ত অবস্থায় ফেলে দিয়ে যাওয়ার পর ওই অসুস্থ হুজুর ভাই আমাকে বাথরুম থেকে হাতে কোস করে পানি মুখে দিছিলেন, আর সাহস দিলেন। কিছু দোয়া পড়তে বললেন। অল্প সময়ে নিজের আপনজন অনুভব করলাম।)
হায়েনারা আমাকে বলির পাঠা বানাতে চেয়েছে.. লম্বা এক লিস্ট ধরে জিজ্ঞাসা করছিলো আর মারছিলো। ফেসবুকে ডুকে আমার দেয়া পোস্ট পড়ছিল আর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছিলো! মোবাইলে কার সাথে কথা হয়েছে সেগুলো সত্য মিথ্যা বলে স্বীকারোক্তি চাইলো। তারা চাইছিলো আমার স্বীকারোক্তি দিয়ে কয়েকজনকে ধরতে… এর মধ্যে রুহুল কবির রিজভী, অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম, এহছানুল হক মিলন, জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার সহ চাঁদপুর, কচুয়ার বিএনপি এবং সহযোগী সংগঠনের আরও অনেক নাম… যদিও অনেকের সাথে আমার সরাসরি কথা হয়নি কিংবা মোবাইলে…
তবুও তারা বলছিল…বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়ে গালিগালাজ করতো আর বলতো তোর খাম্বা বাবা কখনোই তোদের রক্ষা করতে পারবেনা। তারেও বাইন্দা পিটাবো। এসবকিছু হতো চোখ বেঁধে… লুংগি পড়া ঘুমন্ত অবস্থায় বাসা থেকে নিয়ে আসায় পরনে শুধু লুংগি, আর শাট পরিহিত ছিলো… বিশ্বাস করেন যদি সে সময় ছবি তোলা যেতো তবে বুঝাতে পারতাম কতটা অত্যাচার তারা আমাকে করেছিল!
এরমধ্যে তারা আমাকে বললো, কোটা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনে বিএনপির পক্ষে নাকি সাইবারে উস্কানি দিয়ে সারাদেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি করেছি, হাসিনাকে উৎখাতে অন্যদের সাথে ষড়যন্ত্রে জড়িত। তাই তারা বিচারের আগেই, গুম অবস্থায় বলে যদি এখন ক্রসফায়ারে না মারা যাস তবে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে! তবুও কাউকে ফাঁসাইনি! শুধু আল্লাহর সাহায্য চেয়েছি। আমার মতো অন্যদের বিপদ আসুক চাইনি! সেদিন চাইলে ২০/২৫ জনকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজের উপর অত্যাচার কমাতে পারতাম! আমাকে দিয়ে কয়েকজন কাছের সহযোদ্ধাকে ধরার জন্য ফোন দিয়ে আঁড়ি পেতেছিলো।তারা যেভাবে শিখিয়ে দিতো কেন জানি মন মানতোনা তাদেরকে বিপদে ফেলি।তাই এমনভাবে বলতাম যেনো কিছুটা অপরপাশে থাকা ভাইটি বুঝতে পারে। এইজন্য তারা রাগে আমাকে পিঠের উপর বসা অবস্থায় পরপর কয়েকবার লাথি মেরেছিলো! আমি লুটিয়ে পড়ি। অজ্ঞান হয়ে যাই।
এভাবে করে পালাক্রমে জিজ্ঞাসার নামে মারতো, অত্যাচার করতো, থাপ্পড় দিতো, কপাল ওয়ালের সাথে ঠেকিয়ে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরাতো, চেয়ারে বসিয়ে শক দিয়েছে, হাতের আংগুলে কিছু একটা দিয়ে চাপ দিতো, প্রচন্ড ব্যথা পেতাম। দুই পায়ে, পায়ের পাতায়, হাঁটুতে, দুই হাতে, নিতম্বে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করেছে, গায়ে যেহেতু শুধু লুংগি আর শাট ছিলো সেহেতু মারলে খুবই ব্যাথা লাগতো! লুংগি শরীরে থাকতোনা! অন্ডকোষে একবার আঘাত পাওয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অনেকক্ষণ পরে যখন জ্ঞান ফিরে তখন ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠি।মা মা ডাকি। আমি যে কাঁদি তা আওয়াজ হয়না.. আর চিৎকার করতে পারিনা। ক্ষুধা লাগায় বেশ কয়েকবার পঁচা, এঁটো জিনিস খাইছি। একবার অন্ধকার রুমের এক কোনে পড়ে থাকা শুকনা খিচুড়ি খেয়ে নিজেকে বাঁচাই! বাথরুমে প্রশ্রাবের জন্য পা টিপে টিপে হামাগুড়ি দিয়ে যেতাম না, যেতাম বাথরুমের পানি মুখে দিয়ে গলা ভিজানোর জন্য…কিছু সময়ের জন্য আলাদা করে এসব ঘরে রাখলেও কোনো কাথা, কিংবা বালিশ কিছুই ছিলোনা… ওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে আরাম খুজতাম! এইসময় গুলোতে আমার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, তবুও কখনো ঘুম পেয়ে গেলে নিজেকে বিদ্ধস্ত খুঁজে পেতাম।
পাষণ্ডরা তাদের শিখিয়ে দেয়া কথা ভিডিওতে বললে ছেড়ে দেবে বলে মিথ্যাচার করেছিল… অন্তত ৫ জনকে ফাঁসিয়ে দিয়ে বক্তব্য দিলে তারা নির্যাতন করবেনা বলে চেঁচামেচি করে বলেছে… এই অত্যাচারীদের মধ্যে ২ জন মানুষ পেয়েছিলাম যারা আমার করুণ অবস্থা দেখে ব্যথিত হয়েছে, একজন এক গ্লাস পানি দিয়েছে এবং আমার পরিবারকে জানানোর ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলো… একজন মাইরের বেগতিক অবস্থা দেখে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ছাড়িয়ে নিছে অন্যরুমে;সেখানে নিয়ে সে দেড় দিন না খাইয়ে থাকা আমাকে তাড়াহুড়ো করে ৩ মুঠো ভাত খাইয়েছে,পানি দিছে আর পরামর্শ দিছে কখনোই যেনো মিথ্যা স্বীকারোক্তি না দেই!
আরও বিভৎসতা দেখিয়েছে তারা! আমি কখনোই চাইনি আমার মা-বাবা, ভাই, পরিবার, আত্মীয়স্বজন এসব জেনে কষ্ট পাক! তাই খুব কাছের ২/৩ জন মানুষকে কিছুটা জানিয়েছিলাম… তাছাড়া আওয়ামী জাহেলিয়াতের ভয়তো ছিলোই! আল্লাহ বাচিঁয়ে রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।।।
এম ওয়ালিউল্লাহ সরকার তৌহিদ, সাবেক ছাত্রনেতা,
সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক, কচুয়া উপজেলা ছাত্রদল।