মাটির কোনো স্পর্শ ছাড়াই চারা তৈরি করে সাড়া ফেলেছে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার সাইদুর রহমান নামের এক যুবক। মাটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে জৈবসার মিশ্রন ও নারিকেলের ছোবড়া। নেট হাউজের ভেতরে উৎপাদন করায় রোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে এসব চারা। আর আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করায় এসব চারার মানও বেশ ভাল।
এই পদ্ধতির নাম ‘কোকোডাস্ট’। কোকোডাস্টের এই পদ্ধতিতে চারার মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে। চারা সুস্থ ও সবল থাকে। যার কারণে পোকামাকড় ও রোগবালাই কম হয়। সর্বোপরি এই চারার মাধ্যমে সবজি চাষ করলে কৃষক শতভাগ লাভবান হয়। শুধু স্থানীয় কৃষকরাই যে এতে আগ্রহ হচ্ছে তা নয়, বাণিজ্যিকভাবে এসব চারা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
জানা যায়, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ভাটই বাজারের পাশে একটি শেডের চারদিকে নেট (জাল) দিয়ে ঘিরে কোকোডাস্ট পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছেন নার্সারি মালিক সাইদুর রহমান। ওই এলাকার হেলাল উদ্দিনের ছেলে সাইদুর রহমান ২০২১ সালে করোনাকালীন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষিতে আসেন। একপর্যায়ে চারা কিনতে ঝামেলা হওয়ায় নিজে চারা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান।
শুরুতে অনলাইনের মাধ্যমে নারিকেলের ছোবড়া, প্লাস্টিকের ট্রেসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে নিজ অফিসের সামনে চারা উৎপাদন করেন তিনি। প্রথমে ৫ হাজার চারা উৎপাদন করলেও বর্তমানে তার নার্সারিতে তিন লাখ চারা তৈরির ধারণক্ষমতা রয়েছে। টাইটান এগ্রো নামের এই নার্সারিতে বর্তমানে টমেটো, মরিচ, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, স্কচ, লেটুসপাতা, পেঁপে, লাউ, ফুলকপি ও বাঁধাকপিসহ ১৫ থেকে ২০ ধরণের চারা তৈরি হচ্ছে। প্রথম দিকে তেমন সাড়া না পেলেও বর্তমানে প্রতি মাসে তিন থেকে ৪ লাখ টাকার চারা বিক্রি হচ্ছে, যা পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
সরেজমিনে ‘টাইটান এগ্রো’ নামের ওই কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি প্লাস্টিকের ট্রে সাজানো। তাতে সারিবদ্ধভাবে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির শাকসবজির চারা। তবে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এসব চারার সঙ্গে মাটির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চারা উৎপাদনে আধুনিক এই পদ্ধতিটি সবখানেই ছড়িয়ে দিতে পারলে ফসল উৎপাদনে ভালো ফলন পাবেন কৃষক। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে কোনো কীটপতঙ্গ আক্রমণ করতে পারে না। ফলে সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে ওঠে চারা। প্রতি শতাংশ জমিতে কোকোডাস্ট পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হলেও বিক্রি হয় লাখ টাকার বেশি।
উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান বলছেন, কোকো ডাস্ট ব্যবহার করে কেঁচো সারের সমন্বয়ে মাটি ছাড়াই সবজির চারা উৎপাদন করা হচ্ছে প্লাস্টিক ট্রে তে। আধুনিক এ পদ্ধতিতে তৈরি হাউজের চারপাশে নেট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। যেখানে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ নিশ্চিত হয় এবং ক্ষতিকারক পোকামাকড় থেকেও সবজির চারাগুলো রক্ষা পায়। তাপ নিয়ন্ত্রণ ও ঝড়-বৃষ্টি থেকে চারাগুলো নিরাপদে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ পলিথিন।
সাইদুর রহমান জানান, আমি মূলত ব্যবসায়ীক মানুষ। করোনার সময়ে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় তখন কৃষিতে আসার সিদ্ধান্ত নিই। প্রথমে আমার অফিসের সামনে ৫ হাজার চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর বাড়ির পাশে একটি কারখানা তৈরি করে সেখানে বর্তমানে তিন লাখ চারার তৈরির উপযোগী হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বাজারের অন্যান্য চারার থেকে একটু দাম বেশি হলেও চারা মারা যাওয়ার হার একদমই কম। তবে এটা অনেকেই বুঝতে চায়, আবার অনেকে চায়না। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ শতাংশ কৃষক এই সিডলিং নার্সারি করে, তারা আধুনিক এই পদ্ধতিতে উৎপাদন হওয়া চারা দিয়ে নার্সারি করলে বেশি লাভবান হবে বলে আমি মনে করি।
এদিতে তার আধুনিক এই নার্সারিতে চারা তৈরি ও পরিচর্যায় কাজ করছেন ৫ জন শ্রমিক। তারা বলছেন, প্রতি মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন তারা। এতে তাদের সংসারেও ফিরেছে সচ্ছলতা।
হোসেন আলী নামে এক শ্রমিক বলেন, সবজির চারাতে ওষুধ, সার, পানি দেওয়াই আমার কাজ। এছাড়া যারা চারা কিনতে আসেন তাদের সহযোগিতা করি। মাসশেষে যা টাকা পাই তা দিয়েই ভালোভাবে সংসার চলছে।
শৈলকুপা উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আরিফুজ্জামান বলেন, কৃষক সাইদুর রহমান প্রথমে আমাদের কাছ থেকে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাকে আমরা কৃষি লোনসহ কিভাবে চারা উৎপাদন করতে হয় সেই প্রশিক্ষণ আমরা দিয়েছি। বর্তমানে সেখানে আরও একটি মশলা প্রকল্পের চারা উৎপাদনের জন্য আধুনিক শেড তৈরি করতে যাচ্ছি। মৌসুমের আগেই বাজারে যে সবজির দাম বৃদ্ধি থাকে সেসময় কৃষক আগাম সবজি বিক্রি করে অধিক লাভবান হয়। এ কারণে মাটি ছাড়া চারা উৎপাদনপদ্ধতি ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।