মানবসমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্বিক আবিষ্কার ইথিওপিয়ায়, প্রথম কফির সদ্ধানও পাওয়া যায় এখানে

মানবসমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্বিক আবিষ্কার ইথিওপিয়ায়, প্রথম কফির সদ্ধানও পাওয়া যায় এখানে

ইথিওপিয়া ভ্রমন-২য় পব

ফারুক আহমেদ, আদ্দিসআবাবা, ইথিওপিয়া থেকে ফিরে ঃ ইথিওপিয়াই প্রথম কফি সদ্ধান পাওয়া যায়। এ জন্য ইথিওপিয়ার কফিকে বিশ্বের সেরা কফি বলে মনে করা হয়। নবম শতকে ইথিওপিয়ার কাফফা অঞ্চলে প্রথম কফি বিনস্ এর সন্ধান পান ‘কালদি’ নামের এক মেষপালক। পোষা মেষ পালের কফি বিন্স্ খেয়ে বেশি লম্ফঝম্প করার কারণ অনুসন্ধানে তিঁনি আন্দাজ করতে পারেন এই বিন্স্- এর উপকারীতা। পরবর্তীতে এই মেষপালকের মাধ্যমেই কফির মহাত্ম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।
আদ্দিসআবাবার প্রতিটি অলিতে-গলিতেই কফির দোকান। এখানে কফি বেশ আয়োজন করেই খাওয়া হয়। কফি ইথিওপিয়াতে ‘বুনা’ নামে পরিচিত। এটি এখানকার সবথেকে জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী পানীয়। যে কোন দেশের পর্যটকই এখানে ভ্রমণ করলে তার প্রথম কাজ থাকে এখানকার বিশ্বসেরা কফি কেনা। আমিও তাই করেছি। হোটেল লাউঞ্জেই কফি কিনতে গিয়ে দোকানী জানালেন কফি আপ্যায়ন নিয়ে একটি খুব মজার প্রথার কথা। সেটি হলো- ইথিওপিয়ানরা কফি খাওয়ার দাওয়াত দিলে সে বাড়িতে প্রবেশ দ্বারে বা ফ্লোরের সম্পূর্ণটাই সুগন্ধী টাটকা ফুল আর ঘাস ছড়িয়ে রাখা হয় যাতে করে ‘মন্দ আত্মারা’ আসতে না পারে। এরপর তারা অতিথিদের ‘বুনা’ বা কফি দিয়ে আপ্যায়ন করে। কফি ছাড়া এখানকার কোন অনুষ্ঠানই হয়না।
আফ্রিকার উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত ইথিওপিয়া একটি ‘ল্যান্ডলক্ড’ দেশ। চারদিকে রয়েছে সুদান, ইরিত্রিয়া, জিবুতি, সোমালিয়া এবং কেনিয়া। এই দেশগুলিকে একত্রে দেখলে মনে হয় যেন একখানা গন্ডারের শিং – তাই এই অঞ্চলটি ”Horn of Africa’ ‘ নামেও পরিচিত। ইথিওপিয়ার প্রধান ভাষা হল ‘আমহারিক’। এছাড়া অন্যান্য স্থানীয় ভাষাসহ ইথিওপিয়ার মানুষরা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে। ইথিওপিয়া আফ্রিকার একমাত্র দেশ যেখানে কোনো দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন হয়নি। বহুদিন এখানে রাজকীয় শাসন চলেছিল। ইথিওপিয়া এখন একটি গণতান্ত্রিক দেশ। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সকল ক্ষেত্রেই আফ্রিকাকা মহাদেশের মধ্যে এ শহরটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী। আদ্দিস আবাবা ইথিওপিয়ার রাজধানী ছাড়াও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর, একই সাথে একটি প্রদেশ। আফ্রিকার দেশসমূহের সংস্থা ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’ এ শহরকে কেন্দ্র করেই গঠিত। রাজধানী আদ্দিস আবাবার প্রাণকেন্দ্রে ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’ এর সদরদপ্তর। আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়ির বহর এবং বিভিন্ন জাতি এবং ভাষাভাষির সরব পদচারনা এখানে। মনে এটি আফ্রিকানদের জাতিসংঘ। এজন্য আদ্দিস আবাবাকে প্রায়ই ‘আফ্রিকার রাজধানী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইথিওপিয়ায় প্রায় ৮০টিরও বেশি জাতির মানুষ আছে যারা ৮০টিরও বেশি ভাষায় কথা বলে। এজন্য ইথিওপিয়ায় বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের এক বিচিত্র সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে ইথিওপিয়াকে বিশ্ব ইতিহাসে বিখ্যাত বলে মনে করা হয়। ইসলামের ইতিহাসে ইথিওপিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গীর্জাগুলোর একটির অবস্থান ইথিওপিয়ায়।
ইথিওপিয়া লুসির জন্যও বিখ্যাত। ‘লুসি’ ৩২ লক্ষ বছর পূর্বের এক কিশোরীর কঙ্কালের জীবাশ্ম। ‘লুসি’ এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচাইতে পুরানো পূর্ণাবয়ব মানুষের পূর্বসূরির দেহাবশেষ। ১৯৭৪ সালে আবিষ্কারক দলনেতা জীবাশ্ম নৃ-বিজ্ঞানী ডোনাল্ড জোহানসন আবিস্কৃত কিশোরীর নাম দেন ‘লুসি’। ইথিওপিয়ার মানুষেরা অবশ্য এর নাম দিয়েছে ইথিওপিয়ান ভাষায় ’দিনকেনেশ’ যা বাংলা তর্জমায় দাঁড়ায় ’তুমি অপরূপা’। লুসিকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসই বদলে যায়। এখন মনে করা হয়, এক সময় আধুনিক মানুষের প্রথম বাস ছিল ইথিওপিয়ায়। পরে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আদ্দিস আবাবার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত খুবই ইতিহাসসমৃদ্ধ ইথিওপিয়ার জাতীয় জাদুঘরে লুসির জীবাশ্ম রয়েছে। মানবসমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্বিক এবং প্রতœতাত্বিক আবিষ্কারের উদাহরণ- ‘লুসি’। একঅর্থে এই জাদুঘরে ইথিওপিয়ার নানারকমের শিল্প-সংস্কৃতির উদাহরণ।
আদ্দিসআবাবার এক নম্বর টুরিস্ট স্পট ‘ইউনিটি পার্ক’। ইথিওপিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় মেনেলিক এর তৈরি প্রাসাদ, ন্যাশনাল গ্র্যান্ড প্যালেসকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে এই ইউনিটি পার্ক। দেশে ফেরার আগের দিন এ পার্ক ভ্রমণকালে এখানকার গাইড বললেন ইথিওপিয়ার জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী অ্যাবি আহ্মেদ পার্কটি নির্মাণ করেন, যাতে ভ্রমণার্থী এবং স্থানীয় মানুষ – সবার কাছে এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জাতীয় সম্পদগুলির সম্পর্কে সচেতন করে তোলা যায়। ‘ইউনিটি পার্ক’ ভ্রমণে দর্শণার্থী বিমোহিত হবেই। এ পার্কটি এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কার্যকর উপস্থাপক। একটি গরীব দেশের বদনাম নিয়েও ইথিওপিয়া তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে। তাদের সেই গর্বের এক অনন্য স্থাপনা এ পার্ক। আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি এবং গৌবরময় ইতিহাস নিয়ে গর্ব করি বটে কিন্তু বিদেশীদের কাছে বা জাতির অনাগত প্রজন্মের জন্য তা’ তুলে ধরার মত আন্তর্জাতিকমানের দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয় এবং অর্থপূর্ণ কোন স্থাপনা আজও তৈরী করতে পারিনি।
এখানে অবস্থানকালে দেখেছি ইথিওপিয়ানরা দরিদ্র হলেও খাওয়াদাওয়ায় বেশ পেটুক। তাদের খাবারের বৈচিত্র দেখে মনে হয়েছে তারা বেশ ভোজনরসিকও বটে। থালায় যখন খাবার নেয় তখন থালায় আর কোন জায়গা থাকে না এবং এবং নারী-পূরুষ নির্বিশেষে অল্প সময়েই থালা শেষ করতে তারা বেশ পারঙ্গম। পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় প্লেট ভরতেও তারা সময় নেয়না।
গরুর মাংসের প্রচুর চল এখানে। নানাভাবে গরুর মাংস রান্নার প্রচলন রয়েছে। সবজিও খাওয়া হয় প্রচুর। ‘ইঞ্জেরা’ ইথিওপিয়ার প্রধান খাদ্য। স্থানীয় প্রায় সব খাবারের দোকানেই ‘ইঞ্জেরা’র উপস্থিতি দেখেছি। ইঞ্জেরা দেখতে এবং খেতে অনেকটা মোটা আটার রুটি বা ‘দোসা’-র মত। এটি তৈরি হয় ‘টেফ’ এর আটা দিয়ে। ‘টেফ’ আফ্রিকা অঞ্চলের প্রাচীন শস্য। ইঞ্জেরার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের মাংস, ডাল বা সবজি দিয়ে তৈরি নানা স্বাদ ও রঙের ঘন গ্রেভি এবং সবজি সেদ্ধ খাওয়া হয়। যেকোন অভিজাত অনুষ্ঠান ‘ইঞ্জেরা’ ছাড়া হয়না। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছও বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশীদের মত ইথিওপিয়ানদের কাছে বিভিন্ন ভর্তাও প্রিয় খাবার। ৫ তারকা হতে শুরু করে অতি সাধারণ খাবারের দোকানেও ভর্তার উপস্থিতি দেখা গেছে, তবে তা’ বিচিত্র সব উপাদানসমৃদ্ধ। ইন্ডিয়ান রান্নার পদ্ধতির সাথে এখানকার রান্নার কিছুটা মিল রয়েছে বলে মনে হয়েছে। তবে ইথিওপিয়ানরা রান্নায় প্রচুর মশলা ব্যবহার করে। নানা রকমের মশলাযুক্ত খাবারে মরিচের আধিখ্য থাকে। এছাড়াও মধু দিয়ে তৈরী বিশেষ এক ধরণের পানীয়ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এ পানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে তারা গ্রহণ করে।

Explore More Districts