কাকের অভাব, ‘প্রায় বিলুপ্ত’ কা কা ডাক!

কাকের অভাব, ‘প্রায় বিলুপ্ত’ কা কা ডাক!

‘ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না’- সহজলভ্যতা আর আধিক্য বুঝাতে হারহামেশাই আমরা এই কথা বলে থাকি। কাকের স্বর কর্কশ, দেখতে কালো, ময়লা-আবর্জনা খায় বলে তার কদরও কম। কাক ডাকলে বিপদ আসে, এমন কথাও প্রচলিত আছে। দেশে কত পাখি নিয়ে আলোচনা-গবেষণা হয়, কাক নিয়ে সাড়া-শব্দও করেন না গবেষকরা। এক সময় বলা হতো, ঢাকায় মানুষের ঘুম ভাঙতো কাকের ডাকে! এখন কি তা হয়? রাস্তার ধারে জমে থাকা পানি কাক চুমুক দিয়ে খাওয়ার দৃশ্য এখনো দেখেন? আচ্ছা! কাক যদি কমে যায়, আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য কি ঠিক থাকবে?

কাককে বলা হয় শহরের পাখি। গ্রামের চাইতে শহরেই বেশি কাক দেখা যায়। কাক সাহসী ও সৌখিন। কাকের বাসায় পাবেন না এমন কোনো জিনিস নেই। যা দেখে পছন্দ হবে, ছোঁ মেরে নিয়ে বাসায় চলে আসবে। রঙিন জিনিসপত্রের দিকে কাকের ঝোঁক বেশি। কাক যেখানে রঙিন কিছু দেখবে তাই নিয়ে বাসায় চলে আসে।

কাকের একটি চমৎকার স্বভাব হলো, স্বজাতির প্রতি তাদের অপরিসীম সহমর্মিতা। কোথাও কোনো কাক বিপদে পড়লে দল বেঁধে কাকেরা সেখানে ছুটে গিয়ে তাকে রক্ষা করে। আবার কোথাও কোনো কাক মারা গেলে সেখানে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে দল বেঁধে উড়তে থাকে। আর কেউ যদি কোনো কাক মেরে ফেলে, তাহলে তার আর রক্ষে নেই। মাথা ঠুঁকরে ‘কা-কা’ স্বরে জীবন অতিষ্ঠ করে দিবে।


কাক সম্পর্কে জানতে উঁকি মারতে হয় উইকিপিডিয়ায়। তথ্য মতে, ‘কাক কর্ভিডি গোত্রের অন্তর্গত একজাতীয় পাখি। উষ্ণমন্ডলীয় সব মহাদেশ (দক্ষিণ আমেরিকা ব্যতীত) এবং বেশ কিছু দ্বীপ অঞ্চলে কাকের বিস্তার রয়েছে। কর্ভাস গণের মধ্যে প্রায় ৪০টি বিভিন্ন প্রজাতির কাক দেখা যায়। কর্ভিডি গোত্রের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বিভিন্ন প্রজাতির কাকে পূর্ণ। অধিকাংশ কাকের দেহবর্ণ কালো রঙের। কাকের উদ্ভব ঘটেছে মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকে এটি উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায় কাক বলতে সাধারণত পাতিকাককে বোঝায়। কাককে পাখিজগতের সর্বাপেক্ষা চালাক পাখি বলে মনে করা হয়।’

কাককে বলা হয় গণতন্ত্রী প্রাণী। যুক্তরাজ্যের একদল গবেষকের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। পক্ষীকূলের মাঝে কাক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তত্ত্বাবধানে কর্নওয়াল এবং নরফোক কাউন্টির ৪০ হাজার কাকের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। ২০২২ সালের মে মাসে ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে তাদের গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, নতুন বাসস্থানের সন্ধান কাকদের জন্য একটি বড় সিদ্ধান্ত। সবাই সম্মত হবার পরই কাকেরা তা বাস্তবায়ন করে। বড় ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে কাকদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত যোগাযোগ হয়। তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বাসস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর একসাথে বসে বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেয়। সিদ্ধান্তে সম্মত হলে একই ধরনের শব্দ করে এবং ক্রমেই শব্দের মাত্রা বাড়তে থাকে।

গবেষকেরা এসব কাকেদের রেকর্ডভুক্ত শব্দ বিশ্লেষণ করে এই মতামত জানিয়েছেন। গবেষক অ্যালেক্স থর্নটন বলেন, ‘যে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে সম্মত হওয়া মাত্রই তারা আকাশে একসাথে উড়াল দেয়।’


কাক আমাদের পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাকের ভূমিকা অনেক। ‘কাক’ নোংরা পচা আবর্জনা খেয়ে আমাদের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। কাককে তাই উপকারী পাখি ধরা হয়। পরিবেশ সচেতন মানুষদের কাছে তাই কাকের গুরুত্ব আছে। কাক কমে গেলে আমাদের পরিবেশেরই ক্ষতি। কাক প্রাণী হিসেবে আমাদের জৈবিক সার্কেলের অন্তর্ভূক্ত। একটি মালা থেকে একটি ফুল পড়ে গেলে সেটি আর মালা থাকবে না, শূন্যস্থান তৈরি হবে।

পাখি গবেষক জান্নাত আরা বার্তা২৪.কম-কে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আচার-আচরণে পরিবর্তন এসেছে। কাকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আগে তো ঢাকায় অনেক গাছপালা ছিলো, কাকেরা সেখানে বাসা বাঁধতো। এখন গাছপালা কেটে ফেলায় কাকেদের কম দেখা যায়। ডাম্পিং এলাকা শিফট করায় কাকেরাও শহর বিমুখ হয়েছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম উল হক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, কাক নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না। কাক কমেছে বলেও আমার মনে হয় না। আগে তো ঢাকায় অনেক টিনের বাড়ি ছিলো, এখন সব অট্টালিকা। টিনের চাল থাকলে কাকের উপস্থিতি টের পাওয়া যেতো। তিনি বলেন, একটি প্রাণী টিকে হতে হলে তার দুটি জিনিসের প্রয়োজন- থাকার জায়গা ও পর্যাপ্ত খাবার। ঢাকা শহরে দুটিই যথেষ্ট আছে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, কাক কিছুটা কমলেও এখনো বিপন্ন না। কাক-চিল বসবাস করে মূলত ময়লা এলাকায়। কাকের বাসস্থান শিফট হতে পারে। বিশেষ করে ময়লার ডাম্পিংগুলো ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাওয়ায় কাকও শিফট হয়ে গেছে। তবে কাকের সংখ্যা কমছে কিনা, এ নিয়ে সার্ভে করার প্রয়োজন আছে।

Explore More Districts