৬ ডিসেম্বর ২০২৩ বুধবার ১০:৫৪:৪৭ অপরাহ্ন | ![]() ![]() ![]() ![]() |
এম,এইচ চুন্নু।।বিশেষ প্রতিবেদকঃ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল সদর-৫ আসনে মর্যাদার লড়াই শুরু হয়েছে। একদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিসিসি’র সদ্য সাবেক মেয়র এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। তাই বরিশালের আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছে। যেখানে সাদিক আব্দুল্লাহ’র পক্ষ নিয়েছে জেলা,মহানগর ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং তার সকল অঙথোনে সংগঠনের নেতাকর্মি্রা। ফলে বর্তমান প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম নৌকা প্রতিক নিয়েও জয়ের ব্যাপারে সন্দিহান। রাজনৈতিক সচেতনমহল মনে করেন সাদিক আব্দুল্লাহ ভোট যুদ্ধে মাঠে থাকলে বিজয় এর মালা তারই গলায় উঠার সম্ভাবনা বেশী।
তাই বরিশাল সদর ৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রভাবশালী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরাতে নৌকা প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বী জাহিদ ফারুক শামীম একের পর এক কৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে সুপারিশ করার পরেও সাদিক আব্দুল্লাহ যখন নির্বাচন প্রশ্নে অনঢ় আছেন, ঠিক তখনই জাহিদ ফারুক ওই প্রতিদ্বন্দ্বীর মনোনয়নপত্র বাতিলের জন্য আপিলের দ্বারস্ত হয়েছেন।।
হফলনামায় তথ্য গোপন করার অভিযোগে করে জাহিদ ফারুকের সমর্থক অ্যাডভোকেট কে বি এস আহমেদ স্বতন্ত্র সাদিক আব্দুল্লাহ’র মনোনয়নপত্র বাতিল চেয়ে আপিল দায়েরর করেছেন।। এর আগে গত সপ্তাহে মনোনয়ন যাচাই-বাছাইকালে নৌকা প্রার্থী জাহিদ ফারুকের সমর্থক অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম রিটার্নিং কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের কাছে অভিযোগ করেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিকের স্ত্রীর নামে আমেরিকায় বাড়ি আছে,কিন্তু তিনি সেটা হলফনামায় উল্লেখ করেননি।
এদিন নির্বাচন কমিশন কারও মনোনয়নপত্র বৈধ বা অবৈধ ঘোষণা না করলেও খবর ছড়িয়ে পড়ে আফজালের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাদিক আব্দুল্লাহ’র মনোনয়ন ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে,যা নিয়ে জাতীয় এবং স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশও হয়।
কিন্তু সোমবার রিটার্নিং কর্মকর্তা বরিশাল জেলা প্রশাসক নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীম এবং স্বতন্ত্র সাদিক সহ যে আট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন,তাদের সকলের মনোনয়নই বৈধ ঘোষণা করেন।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মিডিয়ায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে জানিয়ে দেন দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে সরাচ্ছে না তাদের দল। বরং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে সাফ জানিয়ে দিলে টেনশন দেখা দেয় বরিশাল সদর ৫ আসনে নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক এবং তার অনুসারীদের মধ্যে।
যদিও জাহিদ ফারুক হাল ছাড়ছেন না,বরং তিনি মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহকে ভোটযুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে কৌশল প্রয়োগ করেই চলছেন। সাদিক আব্দুল্লাহ’র অনুসারীরা জাহিদ ফারুকের এই দৌড়ঝাপকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তারা ৭ জানুয়ারির ভোটে অংশ নেওয়ার পুরোদস্তর প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় বলতে গেলে বিষয়টি এমন যে, স্বতন্ত্র সাদিক আব্দুল্লাহ নির্বাচনী ট্রেনে চড়ে আছেন, আর নৌকার মাঝি তাকে পিছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জাহিদ ফারুক কী শেষ পর্যন্ত সাদিকের নির্বাচন ট্রেন থামাতে পারবেন? সাদিকসহ তার পক্ষে অবস্থান নেওয়া জেলা আওয়ামী লীগ ও অনুগত মহানগর আওয়ামী লীগ কী তার (জাহিদ)পক্ষে কাজ করবে কী না এনিয়ে বরিশাল নগরীতে আলোচনার কমতি নেই।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, দল যখন স্বতন্ত্র প্রার্থিতার সুযোগ রেখেছে,মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে সেই সুযোগ বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ লুফে নিয়েছেন। ৫ আসনের বর্তমান এমপি জাহিদ ফারুক দলীয় টিকিট পেলেও সাদিক জেলা ও তার মহানগর আ’লীগ নৌকার পক্ষে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আছেন। উপরন্ত সাদিক নিজেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে লড়েতে চলছেন।
ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সাদিকের অনুকুলে অবস্থান নেওয়ায় নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক টেনশনে থাকবেন এবং সাদিক আব্দুল্লাহকে নির্বাচন ট্রেন থেকে নামাতে চাইবেন এটা অত্যন্ত স্বাবাবিক ব্যাপার। কিন্তু সাদিক তার সিদ্ধান্ত এতই অনঢ় যে, ফলাফল যাই আসুক জাহিদ ফারুকের বিরুদ্ধে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ। নাছরবান্দা নৌকার প্রার্থী জাহিদ দলীয় ভাবে না পারলেও সাদিককে নির্বাচনী মাঠছাড়া করতে একের পর এক কৌশল নিয়ে যাচ্ছেন।
সাদিক অনুসারীদের দাবি, স্থানীয় রাজনীতিতে কর্মীশূন্য জাহিদ ফারুক নৌকা পেলেও আওয়ামী লীগ তার সাথে না থাকায় তিনি হতাশায় পড়ে গেছেন। নির্বাচনে ভরাডুবির আগাম পূর্বাভাস জানান দেওয়ায় তিনি এখন তাদের নেতা সাদিক আব্দুল্লাহ’র মনোনয়ন বাতিল করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে বিশেষ মহল থেকে সুপারিশও রাখেন, কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন স্বতন্ত্র সাদিকের বাহিনীর বিশলতা এবং জনপ্রিয়তা দেখে ‘পাগল’ হয়ে গেছেন। এবং মিথ্যে অভিযোগগসমূহ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়ে সাদিকের মনোনয়নপত্র বাতিলের আবেদন করেছেন।
অবশ্য এই অভিযোগের পাল্টা পদক্ষেপ কী ভাবে নেওয়া যায় তার সমস্ত প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছে সাদিকের মহানগর আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিকের সমর্থক মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন জানান,তাদের নেতার প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে নৌকাপ্রার্থী যে আবেদন করেছেন,তা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন। এবং সকল অভিযোগ খণ্ডনেরও প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ‘নির্বাচনী টিম’।
কিন্তু এসব করে লাভ নেই,জানিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর বলেন,খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকবেন, সে যদি জয়ী হয়ে আসতে পারে,তাহলে তাকে স্বাগত জানাবেন। তাহলে জাহিদ ফারুকের ভোটে ভয় কোথায়? তিনিতো সফল প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন এবং নৌকা পেয়েছেন,কর্মী-সমর্থকও আছে। তাইতো বলছি,‘খেলা হবে’মন্তব্য করেন স্থানীয় আ’লীগের শীর্ষ এই নেতা।
এর আগে দলীয় একটি সমাবেশে মহানগর আ’লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুককে উদ্দেশ করে বেশ কিছু বেফাঁস এবং বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা তৈরি করে এবং জাহিদ ফারুক সমর্থিত সাদিক বিরোধী গ্রুপ মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি সাদিক আব্দুল্লাহ’র নির্বাচন থেকে সরাতে হাইকমান্ডে সুপারিশ করাসহ নানান কৌশল গ্রহণ করেন,যার প্রথম পদক্ষেপ দেখা যায়,মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দিনে গত রোববার। রিটার্নিং কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহ’র মনোনয়নপত্র এর বিষয়ে বলা শুরু করা মাত্রই সাদিকের স্ত্রী লিপি আব্দুল্লাহ’র নামে আমেরিকাতে বাড়ি আছে, এমন অভিযোগ করেন। এই অভিযোগটি রিটার্নিং কর্মকর্তা আমলে না নিলেও জাহিদ ফারুকের সমর্থক মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিমকে লিখিত অভিযোগ করতে পরামর্শ দেন।
জানা যায়,সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই ওই দিন সাদিকের মনোনয়নপত্রটি ঘোষণার অপেক্ষায় রাখা হয়,যা পত্র-পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশ পেলে শহরময় নানা গুজব ছড়ায়। ফলে চরম হতাশায় পড়েন প্রার্থী সাদিক এর অনুসারীরা। কিন্তু এর একদিন পরেই সেমাবার রিটার্নিং কর্মকর্তা জাহিদ-সাদিকসহ ৮ জন প্রার্থীর সকলের মনোনয়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা করলে যেনো উল্লাস শুরু হয় কালিবাড়িতে। বেড়ে যায় নেতাকর্মীদের আনাগোনা এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও জোরালে আকারে রুপ নিলো,সাদিক অনুসারীরা ফিরে পেলো উদ্দাম।
এরই মধ্যে সাদিকের নির্বাচনী কার্যক্রমে গতিশীলতা আসলে নৌকার প্রার্থী যেনো তাকে পিছন থেকে ধরতে চাইছেন। নির্বাচন প্রস্তুতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বীতার কথা ভুলে গিয়ে তিনি যেনো স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহকে আসনে অগ্রসর হতে দিতে চাইছেন না। দ্বিতীয় দফা সাদিকের মনোনয়নে আপত্তি তোলায় এমনটি মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।
যদিও জাহিদ ফারুক অনুসারীরা শুরু থেকে দাবি করে আসছিলেন, সাদিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগ তাকে থামিয়ে দেবে। এবং নৌকার নির্বাচনে বাধ্য করবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু না হওয়ায় তারা বলছেন,সাদিক আব্দুল্লাহ মনোনয়নপত্র আমেরিকা বাসা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেননি,যে অভিযোগটি প্রথম করেছিলেন আ’লীগ নেতা আফজালুল করিম।
একই অভিযোগ নিয়ে দ্বিতীয়বার নির্বাচন কমিশনে গেলেন জাহিদ ফারুকের আরেক সমর্থক একেবিএস আহমেদ। এই আ’লীগ নেতার দাবি,সাদিক আব্দুল্লাহ হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন,কিন্তু তারপরেও তার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই বিষয়ে আবারও লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন আপিল শুনানি করে ‘সঠিক রায়’ দেবেন বলে আশা করেন তিনি।
নির্বাচনে গতিশীলতা না বাড়িয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিককে টেনে ধরার কৌশলকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে না রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তারা বলছেন,যেহেতু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন,মনোনয়ন বঞ্চিতরা জনপ্রিয়তা প্রমাণে স্বতন্ত্র হতে পারবেন,সেখানে নৌকা প্রার্থী জাহিদ ফারুকের এতো আপত্তি কেনো,বিষয়টি বোধগম্য নয়। এছাড়া তিনি মনোনয়ন ফরম তুলতে গিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগের ‘অরিজিনাল’ প্রার্থী দাবি করে যে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন তা সকলের নজরে এসেছে।
একজন এমপি ও একটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও সংসদীয় আসনে স্থানীয় রাজনীতিতে এই নেতৃত্ব দৈন্যতা জন্য জাহিদ ফারুককেই দোষারোপ করা হচ্ছে। তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সফল প্রতিমন্ত্রী কেনো নিজের নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক বলয় বৃদ্ধি করতে গেলেন দলকে এড়িয়ে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বোদ্ধামহল।
রাজনৈতিকভাবে অদুরদর্শী জাহিদ ফারুক বরিশালের এই বাস্তবতায় নৌকা নিয়ে দলীয় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সাদিক আব্দুল্লাহকে নির্বাচনী ট্রেন থেকে টেনে নামানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন না কী ভোটযুদ্ধে অংশে নেওয়ার কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতার পথে অগ্রসর হবেন, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।’
সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক
শেয়ার করতে ক্লিক করুন: | Tweet |