
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে মানিকগঞ্জে ততই জোরালো হচ্ছে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সরবে এবং বিএনপি নিরবে এলাকায় গণসংযোগ করছেন বলে জানিয়েছেন জেলার ভোটাররা।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, মানিকগঞ্জে সংসদীয় আসন সংখ্যা তিনটি। ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলা নিয়ে মানিকগঞ্জ-১ আসন গঠিত। ঘিওরে হালনাগাদ মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৩, দৌলতপুরে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৮০ এবং শিবালয়ে ১ লাখ ৫২ হাজার ১৫১ জন। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৮৪। এর মধ্যে পরুষ ভোটার ২ লাখ ১৯ হাজার ৬২,নারী ভোটার ২ লাখ ১৭ হাজার ২১৯ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৩ জন।
সিংগাইর, হরিরামপুর এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার হাটিপাড়া, ভাড়ারিয়া ও পুটাইল ইউনিয়ন নিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসন গঠিত। সিংগাইরে মোট পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৬, নারী ১ লাখ ২৯ হাজার ৮২৪ এবং তৃতীয় লিঙ্গের বোটার রয়েছেন ২ জন। হরিরামপুরে মোট পুরুষ ভোটার ৬৯ হাজার ৯৭৮, নারী ভোটার ৬৯ হাজার ৪৪১ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ১ জন ভোটার রয়েছেন। সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে মোট পুরুষ ভোটার ৩২ হাজার ৩৮৬ এবং মহিলা ভোটার রয়েছেন ৩২ হাজার ৯০।
মানিকগঞ্জ পৌরসভা, সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও সাটুরিয়া উপজেলা নিয়ে মানিকগঞ্জ-৩ আসন গঠিত। পৌরসভা ও সাত ইউনিয়নে মোট পুরুষ ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩৫ এবং মহিলা ভোটার ১ লাখ ৪ হাজার ৮৪০। সাটুরিয়ায় পুরুষ ভোটার ৭৪ হাজার ৬৪৯ এবং মহিলা ভোটার ৭৫ হাজার ১৮০জন।
ভোটের মাঠ থেকে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে দলের সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রকাশ্যে একে অপরের সমালোচনা করছেন। আর তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নেতাকর্মীদের এমন সমালোচনায় দলের ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছেন নির্দলীয় ভোটাররা।
মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয়) আসনের সাংসদ ও বিশিষ্ট ক্রীড়াব্যক্তিত্ব এএম নাঈমুর রহমান দুর্জয়। তিনি পুনরায় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া, এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন- সাবেক সাংসদ প্রকৌশলী এবিএম আনোরুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম পিপি, দৌলতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম রাজা, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ ও শিবালয় উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান খান জানু।
এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয় ভোরের কাগজকে জানান, মনোনয়ন প্রত্যাশা তো সবাই করে। সবাই সিগনাল নিয়ে ঘুরে, কিন্তু আমার কোন সিগনার নেই। গত দশ বছর আমি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছি। এখন নেত্রীই ভাল জানেন, মনোনয়ন কাকে দেবেন?
বিএনপি সমর্থিত নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিন্নাহ কবীর, সহ-সভাপতি খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু ও জেলা কৃষকদলের আহ্বায়ক তোজাম্মেল হক তোজা মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সারিতে থাকতে পারেন।
বিএনপির তৎকালীন চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু জানান, দেশে নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় এবং বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তবে আমি অবশ্যই মনোনয়নপত্র দাখিল করবো। আমার পারিবারিক ইতিহাস, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং রাজনৈতিক কেরিয়ারে নিরিখে মনোনয়ন পাবার বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।
গত নির্বাচনে এ আসনে জাতীয় পার্টির আবজাল হোসেন প্রার্থী ছিলেন। আগামী নির্বাচনে এ আসনে জাতীয় পার্টির কোন প্রার্থী থাকবেন কিনা এ বিষয়ে কেউ বলতে পারেননি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে এ আসনে নির্বাচনে আসতে পারেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা আবজাল হোসেন খান জকি।
মানিকগঞ্জ-২ (সিংগাইর-হরিরামপুর) আসনের বর্তমান এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। তার বিপরীতে মনোনয়ন যুদ্ধে হরিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু, সিংগাইর উপজেলা চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান হান্নান, প্রকৌশলী সালাম চৌধূরী এবং জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহীউদ্দিনের নাম শোনা যাচ্ছে।
বিএপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন- জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা এবং প্রকৌশলী মঈনুল ইসলাম খান শান্ত। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক শিক্ষা-উপমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম আব্দুল মান্নান।
এ আসনের সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নদীর বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেওয়ান সাইদুর রহমান এবং মমতাজ বেগমের মধ্যে দা মাছ সম্পর্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া, ফেসবুকে মমতাজের স্বামীর আবেকঘন পোস্ট এবং ভারতের হাইকোর্টে তার নামে মামলার কারণে মনোনয়ন দৌঁড়ে দেওয়ান টুটুল এগিয়ে যেতে পারেন।
এমপি মমতাজ বেগম প্রতিবেদককে জানান, নির্বাচনী মাঠে আলোচনা সমালোচনা থাকবেই। মনোনয়ন পাবার ক্ষেত্রে এগুলো কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। আমি আমার আসনে শতভাগ স্বচ্ছতার সাথে জনগণের জন্য কাজ করেছি। মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার সবার আছে। মনোনয়ন দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য পুনরায় মনোনয়ন পাবার বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।
মানিকগঞ্জ-৩ জেলার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন। একসময় এই আসনকে বলা হতো বিএনপির দুর্গ। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা কর্মসূচি ও দলীয় কার্যক্রম নিয়ে ভোটার ও নিজ দলের কর্মীদের চাঙা করার চেষ্টা করছেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ছাড়া একাধারে বিএনপি ছয়বার ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রয়াত নেতা হারুনার রশিদ খান মুন্নুকে পরাজিত করে আলহাজ্ব জাহিদ মালেক স্বপন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় জাহিদ মালেক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃতীয়বার তিনি এমপি নির্বাচিত হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। এ ধারা অব্যাহত রাখতে তিনি জনগণের পাশে থেকে এলকার উন্নয়ন করছেন বলে জানান, এলাকার ভোটাররা।
এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন- স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা বাদরুল ইসলাম খান বাবলু, এফবিসিসিআইএর পরিচালক ও জেলা আওয়মী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তাবারাকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান টিটু।
অপরদিকে, বিএনপির প্রার্থীরা আসনটি পুনরুদ্ধারে চুপিসারে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন- জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা, জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এডভোকেট জামিলুর রশিদ খান, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা, কেন্দ্রীয় যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী আশরাফ। জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হচ্ছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. জহিরুল আলম রুবেল এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বঙ্গবন্ধু সরকারের সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও গণফোরামের সভাপতিমন্ডলীর সিনিয়র সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলাম খান কামাল।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতার বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মোবাইলে ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, আওয়াম লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যাকেই মনোনয়ন দেবেন আমরা নেতাকর্মীরা একসাথে তার জন্য কাজ করবো।
মানিকগঞ্জের তিনটি আসনের সাধারণ ভোটাররা জানান, যারা অপরাধীদের প্রতিপালন করবেন, মাদক ব্যবসায়ীদের রক্ষা করবেন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মাটি ব্যবসা করে কৃষিজমি ধ্বংস করবেন এমন জনপ্রতিনিধি আমরা চাই না। যারা মাদক নির্মূলে ভূমিকা রাখবেন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করবেন, কৃষিখাতকে ত্বরান্বিত করবেন এবং আইন শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটাবেন আমরা এমন প্রার্থীকেই ভোট দেবো।
কেএমএল