টোল আদায়ে হরিলুট

টোল আদায়ে হরিলুট

বিশেষ প্রতিনিধি
তাহিরপুরের অন্যতম চার নৌকাঘাট মামলায় জড়িত থাকায় ইজারা দেওয়া যায় নি। স্থানীয় প্রশাসন এসব ঘাটে ‘খাস কালেকশন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে টোল আদায়ে নামলেও ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ কারণে গেল এক মাসেই এসব ঘাট থেকে সরকার কমপক্ষে ২০ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ এলাকার সংসদ সদস্যের উপদেশ-নির্দেশে এমন হচ্ছে দাবি করেছেন। সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন অবশ্য বলেছেন, ঘাটে ঘাটে চান্দাবাজি-ধান্দাবাজির বিপক্ষে আমি। এসব ঘাট ইজারায় সরকার সামান্য টাকা পায়, কিন্তু মানুষ নির্যাতিত হয় বেশি।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৪২৯ বাংলা সনে তাহিরপুরের পাতারগাঁও নৌকাঘাট থেকে ৪১,৮৬৮ টাকা, ঘাগড়া হতে লাউড়েরগড় নৌকাঘাট ৮৮ লাখ নয় হাজার ৬৫০ টাকা, ডাম্পের বাজার নৌকাঘাট থেকে ১৮ লাখ, বাদাঘাট বাজার নৌকাঘাট থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার এবং শ্রীপুর বাজার নৌকাঘাট থেকে ৮০ লাখ ৩৮ হাজার ৫’শ টাকা ইজারা আদায় করা হয়েছিল।
গেল চৈত্র মাসে এসব নৌকাঘাটের ইজারা মেয়াদ শেষ হলে পুনরায় ইজারার জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। কিন্তু আগ্রহী দরদাতা না পাওয়ায় ও মামলা জটিলতা থাকায় নৌ ঘাটগুলোর ইজারা প্রদান করা যায় নি। ফলে খাস কালেকশনের মাধ্যমে টোল আদায় চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইজারা মেয়াদ উত্তীর্ণ নৌকাঘাটগুলোতে খাস কালেকশনের জন্য উন্মুক্ত নিলাম পদ্ধতি অনুসরণ করে নি উপজেলা প্রশাসন।
কথা ওঠেছে, প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজসে খাস কালেকশনের নামে অতিরিক্ত টোল আদায় হচ্ছে এই ঘাটগুলো থেকে। আদায়কৃত টোল সরকারি কোষাগারে নামমাত্র জমা করে, এর সিংহভাগই চলে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের পকেটে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে কোটি – কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে সরকার।
উপজেলার অন্যতম ঘাগড়া-লাউড়েরগড় নৌকা ঘাট দিয়ে প্রতিদিন সহ¯্রাধিক মালবাহী নৌকা চলাচল করে। এ ঘাটটি তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অধীনে খাস কালেকশনের জন্য দেওয়া হয়েছে। যেখানে যাদুকাটা নদীর উভয় পাশে কার্গো বা দেশীয় বালু পাথর ও অন্যান্য সকল ধরনের মালামাল বহনকারী নৌকা থেকে নুন্যতম ১’শ থেকে সর্বোচ্চ ৭’শ টাকা টোল আদায় করার কথা। কিন্তু প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে এখানে নৌকা বা বাল্কহেড প্রতি ৫’শ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত টোল আদায় করছে স্থানীয় একটি লুটেরা সিন্ডিকেট। নৌকাঘাটে প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকার টোল আদায় করা হলেও সরকারি কোষাগারে সর্বসাকূল্যে গেল এক মাসে জমা করা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার টাকা। একই চিত্র উপজেলার খাস কালেকশনকৃত অন্য নৌকাঘাট গুলোরও।
শ্রীপুর ডিহিবাটী তহশিল অফিস সূত্রে জানা যায়, শ্রীপুর বাজার নৌকাঘাট থেকে গেল এক মাসে ৯২ হাজার টাকা এবং ডাম্পের বাজার নৌকা ঘাট থেকে গেল মাসে ৩৫ হাজার টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। পাতারগাঁও ঘাটে কোন আদায়ই হয় নি।
ঘাগড়া-লাউড়েরগড় ঘাটে চলাচলকারী বালুবাহী এক নৌকার মালিক বললেন, গত বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি হারে টোল নেওয়া হচ্ছে। টোলের রশিদ দেওয়া হলেও তাতে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয় না।
উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ভূমি অফিসের সামনের শ্রীপুর ঘাটে চলন্ত নৌকা থেকেও টোল আদায় হচ্ছে। এখানেও অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি টোল আদায় হলেও, রশিদে টাকার পরিমাণ উল্লেখ থাকে না।
শ্রীপুর ডিহিবাটী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার রুহুল আমিন বললেন, আমাদের জনবল কম, এজন্য খাস কালেকশনে স্থানীয় অন্যদের সহযোগিতা নিতে হয়। অতিরিক্ত খাস কালেকশনের অভিযোগ আমাকেও দিনে পাঁচ-সাতজন জানায়। আমি ইউএনও স্যারকে ফোন দেবার জন্য বলে দেই।
তাহিরপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার রাজর্ষি রায়ও বললেন, অফিসে তিনজনের পদ থাকলেও একা কাজ করছি। খাসকালেকশনকে বেশি গুরুত্ব দিলে আমার অফিস চলবে কীভাবে প্রশ্ন রেখে বললেন, এজন্য ইউএনও স্যারেকে জানিয়েই কালেকশন আদায়ে স্থানীয় কিছু লোকজনের সহায়তা নিয়েছি।
জেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি, তাহিরপুরের বাসিন্দা সেলিম আহমেদ বললেন, এলাকার সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে চাপে ফেলে তার অনুসারীদের দিয়ে এসব নৌকাঘাটে খাস কালেকশনের নামে অতিরিক্ত টোল আদায় করাচ্ছেন। আবার সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হচ্ছে নামেমাত্র।
উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা মো. নিজাম উদ্দিন বললেন, স্থানীয় প্রশাসনকে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে খাস কালেকশনের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তা না করে রাজনৈতিক চাপের মুখে নামমাত্র টাকায় অলিখিতভাবে এসব ঘাটের খাস কালেসশন দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
এদিকে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, প্রশাসনের লোকজন দিয়েই খাস কালেকসন করা হচ্ছে, এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই। এ ধরণের কোন অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বললেন, কাগজেপত্র খাসকালেকশনে তহশিলদারের নাম থাকলেও শুনা যাচ্ছে এসব ঘাটগুলোতে অর্থ আদায় করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অতিরিক্ত টোল আদায়ে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। আবার সরকারও রাজস্ব পাচ্ছে না।
সুনামগঞ্জ আদালতের জিপি অ্যাড. আক্তারুজ্জামান সেলিম বললেন, মামলায় জড়িত ঘাট নিয়ম অনুযায়ী খাসকালেকশন হতে পারে, কিন্তু ওখানে ব্যক্তি পর্যায়ের কেউ টোল আদায়ের সুযোগ নেই।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বললেন, সকল ঘাটের বিপক্ষে আমি। ঘাটের নামে চাঁদাবাজি-ধান্দাবাজি হয়ে থাকে। বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাট ইজারার বিরুদ্ধেও কথা বলেছি আমি। লোড-আনলোডিংয়ের জন্য যদি কোন ঘাট থাকে এবং ব্যবহারকারীদের সুবিধা দেওয়া হয় সেটি ইজারা হতে পারে। কিন্তু চলতি নদী থেকে টাকা নেবার বিপক্ষে আমি। ঘাট কেন দিতে হবে। নদীতে নৌ-পুলিশ আছে, তারাও এসব চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কী করছে আমি জানি না। কে কী বলেছে জানি না, যারা ঘাটের নামে চঁদাবাজি করছে, তারা কেউ আমার লোক নয়। আমি এসব প্রশ্রয় দেই না।

Explore More Districts