সিলেটের বন্যাদুর্গতদের সহযোগিতায় মাঠে সুনামগঞ্জের ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে ঢাকার সামাজিক সংগঠন মেহমানখানা। ঈদের দিন জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার দুর্গম বেলি ইউনিয়নের হরিণাকান্দি হাওরে ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি গরু কোরবানি করবে তারা। এরপর সেই গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা মাংস ও ভাত বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
সুনামগঞ্জের দুর্গম এলাকার বানভাসিদের কাছে কীভাবে ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছে দিচ্ছেন জানতে চাই মেহমানখানার চেয়ারম্যান আসমা আক্তার লিজার কাছে। তিনি সংবাদ সারাবেলাকে বলেন, ‘আমরা মেহমানখানা গত ২২ জুন থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় সমাজসেবীদের সহযোগিতায় ত্রাণ করছি। এ পর্যন্ত টানা ১৯ দিনের এই কর্মসূচিতে প্রথম দিকে আমরা পানিবন্দি মানুষদের কাছে রান্নাকরা খাবার (খিচুড়ি) বিতরণ করেছি। কনফিডেন্স গ্রুপের সহযোগিতায় প্রতিদিন ১ থেকে ৫ হাজার মানুষকে খিচুড়ি ও রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমরা দূর্গম এলাকা মদনাকান্দি, নয়াপারা, হিজলা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে কাজ করে যাচ্ছি। এই পর্যন্ত আমরা ৮ হাজার মানুষ এর হাতে ত্রাণ সামগ্রি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- চাল, ডাল, আলু, পেয়াজ, মসলা, দুধ, সেমাই, ওষুধ ও খাবার স্যালাইন।
সিলেটে কীভাবে চলছে ত্রাণ তৎপরতা
-শুকনা রুটি-কলা আর গেলা যায় না। সবাই পাউরুটি, মুড়ি, চিড়া, দেয়। আপনারা এত বড় বড় হাঁড়ি আনছেন, আপনারা কি ভাত দেবেন?
-আমরা খিচুড়ি দেব।
-তা হোক, ভাতের দানা তো! আহা রে, কতদিন পর ভাতের দানা পেটে পড়ব! আল্লাহ আপনাগো বালা করুক।
মেহমানখানার এক স্বেচ্ছাসেবক আর সিলেটের জকিগঞ্জের সাহায্যপ্রত্যাশী বন্যার্ত এক অসহায় মানুষের কথোপকথন ছিলো এ রকম। করোনাকাল থেকে লিজা আসমা আক্তার লিজার নেতৃত্বে ঢাকার লালমাটিয়ায় চলছে মেহমানখানার কার্যক্রম। মেহমানখানার উদ্যোগে বন্যার শুরু থেকেই সিলেটে চলছে ত্রাণ বিতরণ। নৌকা ও কলার ভেলায় করে বন্যায় ডুবে যাওয়া প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরে ঘরে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়েছে মেহমানখানা ও জকিগঞ্জের সেচ্ছাসেবকরা।
নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ
সিলেটের জকিগঞ্জে থাকতেই লিজা দেখেন, সেখানকার নারীদের অনেকেরই একটিমাত্র শুকনা পোশাক। সেটিও আবার পিরিয়ডের রক্তে লাল। সে রকমই এক নারী লিজাকে বলেছিলেন, ‘এক বেলা না খেয়ে থাকা যায়। কিন্তু এ রকম করে কতক্ষণ থাকা যায়? শরমে খিদার কথা ভুইল্যা যাই।’ এরপর মেহমানখানার উদ্যোগে সিলেটের দুর্গম এলাকার নারীদের জন্য শুরু হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন। তাদের এসব সরবরাহে পাশে দাঁড়িয়েছে কনফিডেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। তারা মেহমানখানাকে এক হাজার স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করে।
মেহমানখানার সহযোগিতায় নৌবাহিনীর সদস্যরা
মেহমানখানার উদ্যোক্তা লিজা জানান, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সহায়তায় জামালগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়ে থাকছেন তারা। প্যাকেটে করে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন সেখারকার একটি স্কুলে খাবার রান্না করা হচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে খাচ্ছে প্রায় ৩ থেকে ৪শ’ মানুষ। সেখানে আর কত দিন থাকবেন জানতে চাইলে লিজা বলেন, ‘এখানে যে কী পরিমাণ ত্রাণ দরকার, এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। কোরবানির ঈদ আমরা এখানেই করব। এবার সেমাই-চিনিতে নয়; বরং বন্যায় ভাঙা ভবন মেরামতের মধ্য দিয়েই কাটবে আমাদের ঈদ।’
মেহমানখানার সাথে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা
বন্যা দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতার এই কাজে মেহমানখানার সাথে হাতে হাত ধরে কাজ করছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল। লিজা জানান, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলছে ত্রাণ কার্যক্রম। এছাড়া মেহমানখানার সঙ্গে আছে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ডিজাস্টার রিলিফ কমিটি এবং কানাডার হোপ বাংলাদেশ।
চলছে খিচুড়ি বিতরণ
লিজার মাধ্যমেই কথা হয় সেখানে উপস্থিত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শফিকুর রহমানের সঙ্গে। নৌবাহিনীর এই সদস্য বলেন, ‘এখানে অনেক গ্রাম হাওড়ের ভেতর ছোট ছোট দ্বীপের মতো। সেসব গ্রামের সঙ্গে বাকি বিশ্বের এই মুহূর্তে কোনো যোগাযোগ নেই। আমরা এখানে ৩৩ জনের একটা টিম কাজ করছি। আমরা আগে গ্রামগুলো চিহ্নিত করে গ্রাম, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এভাবে একটা ম্যাপ বানিয়ে রেড জোন চিহ্নিত করছি। এসব গ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ যায়নি। আমাদের যেহেতু নৌযান আছে, তাই এসব গ্রামে সবার আগে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’
আসমা আক্তার লিজা আরও জানান, ‘জামালগঞ্জের হরিণাকান্দি হাওরে আমরা একটি মসজিদ, ৩টি ঘর মেরামত করে দিচ্ছি। চলছে ৩টি টয়লেট নির্মাণ কাজ। এছাড়া ঈদের পর এই এলাকার ৯টি মসজিদ, একটি মন্দির, ৫০টি ঘর, ২০টি চাপকল ২০টি টয়লেট ও জেলে পাড়ায় একটা স্কুল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।’