মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান গ্রামের কাজী খয়রদ্দিন রবি একজন পল্লী চিকিৎসক; কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতো তিনি বিভিন্ন জটিল রোগের রোগী দেখেন। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাগোয়ান গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এক নিভৃত পল্লী। গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে গ্রাম্য চিকিৎসকের ঠিকানা দেখিয়ে দেয় তারা। তাঁর চিকিৎসালয়ের নাম আজিজ মেডিক্যাল হল। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অন্য কোথাও এই নাম লেখা নেই। দ্বিতল ভবনের নিচতলায় দুটি কক্ষ। একটিতে খয়রদ্দিন রোগী দেখেন। অন্যটিতে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন কম্পানির ওষুধ। চেম্বারে প্রবেশ করতে চাইলে ব্যবস্থাপক তাহাজ উদ্দিন পরিচয় জানতে চান। পরিচয় জানার পর চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে দেন। সেখানে গাংনী উপজেলার হাড়িয়াহ গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন মর্জিনা বেগম। রোগীর বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর। সঙ্গে রয়েছেন স্বামী গোলাম হোসেন। দেখার পর মর্জিনা বেগমকে ওষুধ লিখে দিলেন সাতটি। এগুলোর নাম পার্কিলিন, ডি-ডোপা, টেরোডিন, ক্লোন, ইসোকন, সেরিটন, নিউরেপ। এগুলো সাধারণত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) রোগীদের ক্ষেত্রে লেখা হয়।চিকিৎসা নেওয়ার সময় মর্জিনার স্বামী গোলাম হোসেন খয়রদ্দিনকে বলেন, ‘তার স্ত্রীর বাঁ পায়ে এখনো অবশ কাটেনি। ব্যথা করে। তাতে গুরুত্ব না দিয়ে ওষুধ লিখে ম্যানেজারের হাতে প্রেসক্রিপশন তুলে দিলেন।’ তখনই প্রেসক্রিপশনের একটি ছবি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তুলে নেন এ প্রতিবেদক। গোলামকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, তিন মাস আগে তাঁর স্ত্রীর বাঁ পাশ অবশ হয়ে যায়। কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও ভালো হয়নি। লোকমুখে শুনে এই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছেন। এর আগেও একবার এসেছিলেন। তবে এখনো রোগীর ভালো কিছু লক্ষ করা যায়নি। মেহেরপুর সদর উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বৃদ্ধ লুত্ফর রহমান বেলস পালসি (মুখ বাঁকা) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর ছেলে লোকমুখে শুনে খয়রদ্দিনের কাছে নিয়ে এসেছেন। এবার দিয়ে দুবার এসেছেন। তাঁরও রোগ ভালো হয়নি। মেহেরপুর সদর উপজেলার খোকসা গ্রামের ওসমান নয়ন বলেন, ‘দোয়াত আলী ও রেহেনা বেগম নামের দুজন স্ট্রোকের রোগী খয়রদ্দিনের কাছে চিকিৎসা নিতে যান। তবে তাঁদের রোগ ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।’ অভিযুক্ত কাজী খয়রদ্দিন রবি বলেন, ‘আমি কোনো প্রচার করিনি। রোগীদের কাছ থেকে শুনে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন।’ মুখ বাঁকা, পক্ষাঘাত, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মতো জটিল রোগের চিকিৎসা দিতে পারেন কি? তাঁর জবাব, ‘আমার জানা নেই।’ কতটুকু লেখাপড়া করেছেন? উত্তরে বলেন, ‘এসএসসি পাস করেছি।’ তবে এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট দেখাতে পারেননি। পাশের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, আজিজ মেডিক্যাল হল মূলত এটাই। গুটিকয় ওষুধ দিয়ে পুরো ফার্মেসি সাজানো। কোনো প্রশিক্ষণ না থাকলেও খয়রদ্দিনের ছোট ভাই কাজী আলাউদ্দিন ওষুধ বেচেন। জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘দুই-তিন বছর ধরে ওষুধ নাড়াচাড়া করতে করতে সব জেনে ফেলেছি।’ কাজী খয়রদ্দিনের চিকিৎসালয়ে যাওয়া বিভিন্ন ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বায়োফার্মা কম্পানির ওষুধ এখানে বিক্রি হয় মাসে দুই লাখ টাকার। এ ছাড়া অন্য কম্পানির ওষুধও ভালো কাটতি রয়েছে। বায়োফার্মা থেকে সদ্য চাকরি ছেড়ে দেওয়া বিক্রয় প্রতিনিধি সাদিক জানান, এখানে মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি হয়। অন্য একটি কম্পানির প্রতিনিধি রেজাউল করিম বলেন, ‘মাসে ১২-১৫ হাজার টাকার ওষুধ বেচি।’ এভাবে ১০-১২টি কম্পানির নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ এখানে বিক্রয় করা হয়। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ আশাদুর রহমান শামিম বলেন, ‘একজন পল্লী চিকিৎসক কখনোই স্ট্রোকের রোগী দেখতে পারেন না। আর তিনি যে ওষুধগুলো প্রেসক্রিপশনে লিখেছেন, তা শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই লেখেন। এদের বিরুদ্ধে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ মুজিবনগর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, খয়রদ্দিন রবির বাবা আজিজুল ইসলাম সব রোগের চিকিৎসা করতেন বলে শুনেছি। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলেও পল্লী চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা করেন। তবে একজন পল্লী চিকিৎসক প্রাথমিক রোগ (জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি ) ব্যতীত কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারেন না। তিনি জটিল রোগী পেলে রেফার্ড করতে পারেন।
মেহেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. জি কে এম সামসুজ্জামান বলেন, ‘একজন পল্লী চিকিৎসক কখনোই জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে পারেন না। আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরো বলেন, ‘রোগীদেরও সচেতন হওয়া দরকার, যাতে জটিল রোগ নিয়ে পল্লী চিকিৎসকদের কাছে না যায়।’ মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পরিমল সিংহ বলেন, ‘তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’মুজিবনগর বিশেষজ্ঞ পল্লী চিকিৎসক! – কুষ্টিয়া নিউজ | Kushtia News