আপডেটঃ 12:02 pm | April 18, 2022
প্রদীপ ভৌমিক ॥ আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে ত্রিশাল উপজেলার বালিপাড়া নামক অজপাড়াগায়। লেখাপড়ার সূত্রে যৌবন কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। ঈদ, পূজা পার্বণ বিভিন্ন উৎসবে নাড়ির টানে চলে যেতাম গ্রামে। তাই আজও পহেলা বৈশাখ এলেই স্মৃতিতে ফিরে যাই অতীতের সেই দিনগুলিতে। আমার বাড়ি ছিল বালিপাড়া বাজার নামক একটি ব্যবসায়ী এলাকায়। তাই পহেলা বৈশাখ এলেই আমরা বুঝতাম হালখাতার দিন। আমার শিশু ও কৈশোর কালে আমাদের বাজারটিতে হিন্দু ব্যবসায়ী ছিল বেশি। সেই সময় মুসলিম ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল কম। বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকেই ব্যবসায়ীরা সারা বছরের দেনা পাওনার হিসাবপত্র সম্পন্ন করে তাদের দোকান ঘর পরিষ্কার করে রঙিন লাল নীল কাগজের ঝালর দিয়ে সাজিয়ে ফেলত। পরের দিন পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ শুভ হালখাতার দিন। হালখাতার দিন প্রত্যেক দোকানে হত সৌভাগ্যের দেবতা গনেশের পূজা। আর মুসলমান ব্যবসায়ীদের গদিতে হত মিলাদ মাহফিল। পহেলা বৈশাখ থেকে বৈশাখ মাস ব্যাপী অনুষ্ঠিত হতো বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বসত বৈশাখী মেলা। মেলায় থাকতো বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রী ও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। নাগরদোলা থেকে শুরু করে মেলায় মিলত পাপড় ভাজা, মচমচে চানাচুর, খাজা, গজা, নিমকি, রসগোল্লা, দই, গরম গরম জিলাপি বিভিন্ন রঙ্গের বুন্দিয়া, আইসক্রিম,রঙিন জলের তোকমা সহকারে শরবত, লজেন্স, বিভিন্ন রং এর কাঠি লজেন্স, এস বিস্কুট ,গুড় চিনির তৈরি খেলনা, বিন্নি খই, চিড়া মুড়ি ও ফুটখৈ, চিড়ার নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া ,আস্ত অথবা ফালি করা তরমুজ, শসা, আতা ফল , বেল,কলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের গ্রামের দেশি ফল। দোকানিরা শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলনা নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসত। তারমধ্যে বাশের বাশী, ঢোল, ডুগডুগি, মাটির পুতুল, রান্নার খেলনাপাতি, কাগজ ও শোলার পাখি, চরকি ,বল বিভিন্ন ধরনের মুখোশ আরো কত কি। এখনকার মতো বন্দুক, পিস্তল, গুলি বিক্রি হতো না তখন মেলায়। মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি ছিল প্রধান আকর্ষণ। ছোট ছোট মেয়ে ও বউ-ঝিরা মেলা থেকে রঙিন কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতে, আলতা ,কুমকুম, সিঁদুর, পাউডার , নারিকেল তৈল ,স্লো প্রভৃতি সারা বছরের জমানো টাকা দিয়ে কিনে নিত। এছাড়াও গৃহস্থালির আসবাবপত্র নিয়ে দোকানিরা দোকান সাজিয়ে বসত। তাতে পাওয়া যেত লাঙ্গল ,জোয়াল, মই থেকে শুরু করে কুলা, চালনি, কাঠের পিঁড়ি ,মাটির হাড়ি পাতিল, দা-কুড়াল, কাঠ ও বাঁশের তৈরি ডাল ঘুটনি, হাতা,ছেনা, বটি ,কোদাল, ছুরি, কাঁচি সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। গ্রামের সেই মেলা গুলি এখন দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিকতা। বাঁশ বেত কাঠের জায়গা এখন প্লাস্টিক ,স্টিল, মেলামাইন, সিরামিকের তৈজসপত্র দখল করে নিয়েছে। মেলায় বহুরূপীরা বিভিন্ন ধরনের সাজ সেজে ঘুরে বেড়াতো। অস্থায়ী ও মহাজনদের দোকান গুলি থেকে টাকা নিত। বহুরূপীদের পিছনে পিছনে ছুটে বেড়াত গ্রামের অর্ধনগ্ন-নগ্ন শিশু কিশোররা। নানা, দাদা, বাবা কিংবা বড় ভাইদের হাত ধরে শিশু, কিশোর ,কিশোরীরা রঙিন জামা কাপড় পড়ে আসত হালখাতা করতে মহাজনদের ঘরে। বিগত দিনের পাওনা মিটিয়ে মিষ্টিমুখ করে মহাজনদের ঘর থেকে বিদায় নিত। আমি আমার গৃহস্থ বাবা ও গ্রামের অনেক গৃহস্থকে দেখেছি চৈত্র মাসের শেষদিকে ধান-পাট, কলাই বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে হালখাতার দিন মহাজনদের দেনাপাওনা মেটানোর জন্য। তখনকার দিনে এটাকে একটা পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করত তারা। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে খেলাধুলা, যাত্রাপালা,নাটক, কবিগান, জারিগান, বাউল গান, সার্কাস ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। গ্রামের মানুষ সন্ধ্যার পূর্বে সমস্ত কাজকর্ম সেরে উপরোক্ত অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করত। আমাদের বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদে হত নৌকাবাইচ, হত গোহাটা মাঠে ষাড়ের লড়াই, হালের বলদ এর দৌড়, কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা ও ফুটবল খেলা। এখনকার মতো ক্রিকেট এত জনপ্রিয় খেলা ছিল না তখন। ফুটবল ছিল সবচাইতে জনপ্রিয় খেলা। তরুণদের মাঝে দুই গ্রামের মধ্য অনুষ্ঠিত হত ফুটবল খেলাটি। শত শত গ্রামের মানুষ খেলাটি উপভোগ করত। সেইগুলি আজ হারিয়ে গেছে। আর সেই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ও সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চস্বরে গান। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামে বাড়ির বিবাহিত মেয়েরা তাদের সন্তান সন্ততি সহ বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসত। পরিবারের সবাই একসাথে বসে সাধ্য অনুযায়ী ভালো-মন্দ আহার করত। পহেলা বৈশাখ সকালে পাড়ার মুরব্বিদের সাথে সাক্ষাত হলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকে পরস্পরকে সালাম, আদাব ও প্রণাম জানাত। সমবয়সী ও সহপাঠীরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় করত। সেই দিনগুলি এখন কোথায় জানি হারিয়ে গেছে। নববর্ষের প্রথম দিনে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে কেটে যেত আমাদের শৈশব কৈশোরের সেই দিনগুলি। এখন নগর সভ্যতায় পহেলা বৈশাখ হয় সমাজের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ,সরকারি কর্মকর্তা ও নির্ধারিত ব্যক্তিদের জন্য সীমাবদ্ধ। এখন আর পহেলা বৈশাখ সর্বস্তরের বাঙালির সার্বজনীন উৎসব নয়। এখন সময়ের শৃংখলে বন্দি হয়ে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ। আমাদের সেই সুখের দিনগুলি কে পিছনে ফেলে রেখে এসেছি তা হয়তো আর কোনদিন ফিরে পাব না। মনে হয় আমরা গ্রামের হিন্দু, মুসলমান,। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।