৮ November ২০২৪ Friday ১০:১৭:৪৩ PM |
মেহেন্দীগঞ্জের চৌধুরী বাড়ি আসলে জমিদারবাড়ি। শায়েস্তা খাঁর আমলে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমন করার জন্য যে সংগ্রাম কেল্লা নির্মিত হয়েছিল, তার একজন সেনানায়ক ছিলেন এই চৌধুরী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। এসেছিলেন পারস্য থেকে। ঘুরে এসে লিখেছেন এলিজা বিনতে এলাহী
বিদ্রোহী কবির প্রাচ্যের ভেনিস বরিশালে বার কতক যাওয়া হলেও দ্বীপকন্যা মেহেন্দীগঞ্জে যাওয়া হয়নি। মেহেন্দীগঞ্জ বরিশাল জেলার একটি উপজেলা। দ্বীপকন্যা শব্দে দেখে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, মেহেন্দীগঞ্জ একটি দ্বীপ এলাকা এবং বরিশালের সঙ্গে কেবল পানিপথেই যুক্ত। কিছুকাল আগেও মেহেন্দীগঞ্জকে একেবারে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ বলে মনে হতো।
বরিশালের এ রকম অনেক স্থানীয় মানুষ আছেন, যাঁরা কখনই মেহেন্দীগঞ্জে যাননি। চারদিকে নদীবেষ্টিত হওয়ার কারণেই এই দ্বীপাঞ্চল মূল বরিশাল জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই হয়তো এই দ্বীপাঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মেহেন্দীগঞ্জের কিছু এলাকা আবার ভোলা জেলার সঙ্গে যুক্ত। দ্বীপকন্যা মেহেন্দীগঞ্জের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সম্রাট আকবরের সেনাপতি শাহবাজ খান, আওরঙ্গজেবের সেনাপতি আগা মেহেদী, সংগ্রাম কেল্লা, শায়েস্তা খাঁসহ পুর্তগিজ, মগ, আরাকান জলদস্যুদের নাম।
ইতিহাসে অবশ্যই প্রবেশ করব, তবে আরও কিছুটা পথ উজিয়ে। তার আগে বলি মেহেন্দীগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্য, কী পেলাম সেখানে, কী দেখলাম ও খেলাম—এসব আরকি। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া ইউনিয়নের বিখ্যাত চৌধুরী বাড়ি ঘুরে দেখা। দ্বীপ এলাকা কেমন দেখলাম, সেই গল্পই এখন করা যাক।
সকাল সাতটায় বের হলাম। এবারের আবাসন ছিল বরিশাল সদরের বরিশাল ক্লাব। ক্লাবের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্থানীয় তরুণ নিথুন। গত দুই দিন সে আছে আমার পথসঙ্গী হিসেবে। এই বরিশাল সফরে আরও আছেন ভ্রমণসঙ্গী আমার গৃহবন্ধু ফাইয়াজ আলম খান। ক্লাব থেকে বের হয়ে সদরের ফাইভ স্টার নামের একটি রেস্তোরাঁয় তিনজন মিলে সকালের নাশতা সেরে নিয়ে সিএনজিযোগে যাই শায়েস্তাবাদ ঘাটে। নিথুনের তথ্য অনুসারে এই ঘাট থেকে স্পিডবোটে গেলে নদীর ওপারে পাতারহাট স্টিমার ঘাটে দ্রুত পৌঁছানো যাবে। স্টিমারও যায় ভিন্ন ঘাট থেকে, তবে সময় কিছুটা বেশি লাগে। ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, ছোট ছোট কয়েকটি মাছ ধরার ডিঙিনৌকা আর একটি স্পিডবোট। মোট ১০ জন বসবে। অল্প সময়ের মধ্যেই স্পিডবোট ছুটতে আরম্ভ করল। স্পিডবোটে দুজন নারী সহযাত্রী পেলাম। তাঁরা আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। বরিশালে আত্মীয় বাড়িতে এসেছি কি না, জানতে চাইলেন।
রোদ নেই শহরে। কিন্তু কেমন যেন গরম হাওয়া এসে শরীরে লাগছে। মনে হচ্ছিল, আজ ভ্রমণ ভেস্তে যাবে বৃষ্টির কারণে, নয়তো ভ্যাপসা ও বাজে গরমের জন্য। বৃষ্টি হচ্ছে না, আকাশে মেঘ আছে; কিন্তু বেয়াড়া গরম বেশ জ্বালাতন করেছে।
আমার আসলে কথা বলায় মন নেই। আমি দেখছি কীর্তনখোলার অপরূপ রূপ। চারদিকে চোখে পড়ছে ছোট–বড় মাছ ধরার নৌকা। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা স্টিমার। কিছু দূর পরপর চোখে পড়ছে নদীর মাঝে জেগে ওঠা দ্বীপচর। সেই দ্বীপচরে রাখাল গরু নিয়ে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো দ্বীপচরে দু–তিনটি বাড়িও আছে। খুব সাধারণ দৃশ্যাবলি। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়গুলোর জন্যই বরিশাল অঞ্চল অনন্য ও স্বকীয়তায় ভরপুর। কীর্তনখোলা নদী আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে উৎসারিত। এই নদীর দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটার। এই কীর্তনখোলা নদীর তীরেই প্রাচ্যের ভেনিস বরিশাল শহর গড়ে উঠেছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই যেন চলে এসেছি! মাত্র ৪০ মিনিটেই পৌঁছে গেছি ঘাটে। খুব সাদামাটা স্টিমারঘাট। কোনো শোরগোল নেই। লঞ্চঘাট থেকে যেতে হবে পাতারহাট বাজারে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন মেহেন্দীগঞ্জের স্থানীয় তরুণ হানিফ। পাতারহাট বাজার থেকে উলানিয়া বাজারে যেতে হবে। উলানিয়া বাজার থেকে হেঁটেই যাওয়া যায় চৌধুরী বাড়ি। অটোরিকশায় যেতে যেতে বাজারে একটি স্কুল দেখলাম পাতারহাট বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৪। অবশ্য অবাক হইনি। এই দ্বীপাঞ্চল আগ থেকেই সমৃদ্ধ। মনপুরায় আমি ১৯০৪ সালের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় দেখেছি। মেহেন্দীগঞ্জের চারপাশ দিয়ে সরু খাল বয়ে গেছে। বাজার পেরুলে পরিবেশটাই অন্য রকম।
ছোটখাটো একটি ভ্রমণ দল হলো বলা যায়। উলানিয়া বাজারে আমাদের অটোরিকশা এসে থামে। আমরা তিনজন স্থানীয় তরুণ হানিফকে অনুসরণ করা শুরু করলাম। পিচঢালা রাস্তার একপাশে একটি বেশ বড় দিঘি, আরেক পাশে একটি গেট। লেখা আছে, ‘উলানিয়া ঈদগাহ, প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬১’। তোরণ নতুন নির্মাণ করা হয়েছে ২০০৪ সালে। তোরণটির পাশেই একটি সমাধিক্ষেত্র। সমাধিক্ষেত্র থেকে এগোলে সামনে আরও একটি দিঘি। কিন্তু এটি কিছুটা ছোট। দিঘিতে কয়েকটি হাঁস সাঁতরে বেড়াচ্ছে। দিঘির সামনেই মসজিদ। স্থানীয় লোকজন বলেন, উলানিয়া জমিদারবাড়ি মসজিদ। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদে চিনি টিকরির কারুকাজ দৃষ্টি এড়ায় না। দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কিছু সংস্কার করা হয়েছে।
মসজিদ পেরিয়ে জমিদারবাড়ি শুরু হবে। ঠিক হলো ফেরার পথে মসজিদ দেখব। আরও বেশ খানিকটা মেঠো পথ পেরোলাম। তারপর একটি ধ্রুপদি স্থাপনা দৃষ্টি কেড়ে নিল। অল্প কারুকাজের নিওক্ল্যাসিক্যাল পিলারগুলো দেখে মনে হচ্ছে না, এটি ডাকঘর ছিল কখনো। এখন যদিও উলানিয়া ডাকঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মেঠো পথের একপাশে ডাকঘর, অন্য পাশে একটি মাদ্রাসা। এটিও উনিশ বা বিশ শতকের স্থাপনা। এই দুই স্থাপত্য পেরিয়ে আরও একটি দিঘি পেলাম। ঘাটলা একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে দিঘিতে মাছের চাষ হচ্ছে। কে বা কারা করছে, তা জানি না। দিঘি পেরিয়ে সামনে দেখা মিলল একটি স্থাপনার। প্রবেশদ্বার অনুমান করে নিই। প্রবেশদ্বারের পাশে ভবন ছিল, সেটি নেই, শুধু মেঝে রয়েছে।
প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে গেলাম। সামনে সাদা রঙের একটি দ্বিতল ভবন। সাদা রং হলো কী করে? দেখলাম, কয়েকজন নারী পর্যটক ঘুরছেন। হয়তো স্থানীয়। সাদা ভবনের সামনে দেখলাম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বোর্ড। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে, এই সফেদ সংস্কার কার কাজ। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ঢাকার আহসান মঞ্জিলের রং বদলে গোলাপি হওয়ার কথা। দেশজুড়ে বাকি স্থাপনা যেমন ময়মনসিংহ রাজবাড়ি, রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়িতে সাদা রং করা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কীই–বা করার আছে!
এই দ্বিতল ভবনটির জানালা-দরজাও সংস্কার করা হয়েছে। জানালার ওপর শিলালিপির মতো কিছু একটা রয়েছে। সেখানে সম্ভবত আরবি ভাষায় কিছু লেখা। এগুলো আগেই ছিল নাকি নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, তা বোঝা গেল না।
সাদা ভবন পেছনে রেখে সামনের দিকে কিছুদূর গেলে একটি আধভাঙা স্যাঁতসেঁতে ভবন। বাড়ির কোনো সীমানাপ্রাচীর পেলাম না। যে প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেখান দিয়ে বের হয়ে নতুন একটি পথ পেলাম। বসতি গড়ে উঠেছে চারপাশে। কিছু জায়গা টিন দিয়ে ঘেরা। এ রকম একটি বাড়িতে একজন নারীকে দেখলাম রান্না করতে। তিনি হাসিমুখে অভিবাদন জানালেন। আমি কিছু বলার আগেই তিনি নিজ থেকেই বললেন, ‘জমিদারবাড়ির কেউ খোঁজ রাখে না। আম–কাঁঠাল—সব গ্রামের মানুষ খায়। আমরা তো ভাড়াটিয়া।’
মনের মধ্যে অজান্তেই কেউ খোঁচা দিয়ে বলল, জমিদারবাড়ির আবার ভাড়াটিয়া কী! দেশজুড়ে ঐতিহ্যের পথে হাঁটতে হাঁটতে কত বিচিত্র পরিস্থিতির সম্মুখীন যে হলাম এযাবৎ, তার ইয়ত্তা নেই। এখন আর এসবে বিস্মিত হই না।
এবার ফিরব। ফেরার পথে মসজিদের সামনে একটু থামলাম। মসজিদের পাশে সুপারিবাগান। সামনে আবারও একটি ভবনের দেখা মিলল। আর একটি দিঘিও। আসলে বাজার পার হওয়ার পর যতটুকু দেখেছি, পুরোটাই আমার কাছে চৌধুরী বাড়ির অংশ মনে হয়েছে। পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রটিও বেশ বড়।
সামনের বড় দিঘিটা দেখিয়ে হানিফ বললেন, এই দিঘি আরও বড় ছিল। নদীর ভাঙন রোধ করার জন্য বাঁধ দেওয়ার ফলে দিঘি ছোট হয়ে গেছে। এ অঞ্চল আসলে খ্যাতি পেয়েছে উলানিয়া জমিদারবাড়ির জন্য। পুরো উলানিয়াই মনে হচ্ছে চৌধুরী বাড়ি। কেবল বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী ছাড়া। হানিফ বললেন, ‘চলেন আপু, নদীর ধারে যাই।’ আরে এই জায়গাকে তো কক্সবাজার বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে! নারকেলগাছ, বাঁধের পাথরগুলো তো একেবারে সৈকতের অনুভূতি দিচ্ছে।
সবাই কিছুটা ক্লান্ত। যে যার মতো করে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে। আমার হাতব্যাগে একটি বই রয়েছে। এ ফাঁকে মনে হলো, যা দেখেছি, কিছুটা মিলিয়ে নিই। বইটির নাম বৃহত্তর বরিশালের ঐতিহাসিক নিদর্শন। লিখেছেন সাইফুল আহসান বুলবুল। সত্যি কথা বলতে, আমি বরিশাল বিভাগের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি এই লেখকের বই পড়ে। তাঁর বই হাতে নিয়ে আমি ঘুরেছি বরিশাল বিভাগের এমাথা–ওমাথা। বরিশালের ইতিহাসের ওপর তিনি ১৩টি বই লিখেছেন।
উলানিয়া চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কে সাইফুল আহসান বুলবুল বলছেন, চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ হানিফ পারস্য থেকে উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। শায়েস্তা খাঁর আমলে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমন করার জন্য নির্মিত সংগ্রাম কেল্লার তিনি একজন সেনানায়ক ছিলেন বলে জানা যায়। সংগ্রাম কেল্লার এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
এ অঞ্চল আগে শাহবাজপুর নামে পরিচিত ছিল। মোগল শাসনামলে বরিশালের যেসব স্থানে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল, শাহবাজপুর এলাকা ছিল অন্যতম। শুধু বিখ্যাত জমিদার হিসেবে তৎকালীন এই পরিবার যে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তা নয়; পরবর্তীকালে এই পরিবারে ওয়াহেদ রাজা চৌধুরী, নুরুল হক চৌধুরী, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, আতিকুল হক চৌধুরী, ফুয়াদ চৌধুরী ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে চৌধুরী পরিবার প্রথম এ এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের গায়ে জনৈক শফির নাম উল্লেখ থাকলেও তাঁর পরিচয় জানা যায় না। ধারণার বশবর্তী হয়েই বলছি, হয়তো জমিদারবাড়ির নির্মাণকালও সমসাময়িক বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এবার ফেরার সময় হলো। সকালের নাশতার পর কিছুই পেটে পড়েনি। তাই হানিফকে বললাম, বাজারের সব থেকে পুরোনো মিষ্টির দোকানে দই-মিষ্টি খেতে চাই। হানিফ নিয়ে গেল আদি সাতক্ষীরা দধি ঘরে। এটিই নাকি এখানকার সবচেয়ে ভালো ও পুরোনো মিষ্টির দোকান। তবে নাম কেন সাতক্ষীরা দধিঘর, সেটি জানা হয়নি। আমরা সবাই মিলে দই-চিড়া আর মিষ্টি খেলাম। মিষ্টির সেই স্বাদ অতুলনীয়। লিখতে লিখতে সে কথা মনে করে জিবে জল চলে এল।
আবারও দেখা হবে এই প্রত্যাশায় হানিফকে বিদায় দিয়ে আমরা পাতারহাট লঞ্চঘাটের পথ ধরলাম। ঠিক হলো, বরিশাল সদরে গিয়ে দুপুরের খাবার খাব। ততক্ষণে অবশ্য দুপুর গড়িয়ে যাবে। সময় মেনে কি আর চলতে পারে কোনো ভ্রামণিক! বাংলাদেশের কোনায় কোনায় এ রকম কত হানিফ আর নিথুন যে আমার ভ্রমণপথের সঙ্গী হয়েছে, তাঁদের সবার ঋণ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।
ছবি: লেখক
সৌজন্যে:প্রথম আলো
শেয়ার করতে ক্লিক করুন: | Tweet |