সিলেট নগর রাজনীতিতে ফের আলোচনায় আরিফ

সিলেট নগর রাজনীতিতে ফের আলোচনায় আরিফ

সিলেট নগর রাজনীতিতে ফের আলোচনায় আরিফসাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী আবারও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সম্প্রতি “সিলেট সুন্দরের” মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম ইতোমধ্যেই নগরবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ কেবল নগরীর নিত্যদিনের সমস্যার সমাধান নয়, বরং আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জনআস্থা পুনর্গঠনের কৌশলও হতে পারে।
দলের ভেতরেও এ নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরিফুল হক চৌধুরীকে সিলেট-১ সংসদীয় আসনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সবুজ সংকেত দেননি। বরং দলীয় কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে তারেক রহমান নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন—আরিফুল হককে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদেই লড়তে হবে।
দলের এই অবস্থানকে অনেকে বিএনপির “ভিত্তি মজবুত করার কৌশল” হিসেবে দেখছেন। কারণ সংসদীয় আসনে ভিন্ন প্রার্থীকে জায়গা দেওয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ তৈরি হবে, আর আরিফুল হকের মতো জনপ্রিয় নেতা নগর রাজনীতিতে থেকে সংগঠনের ভিত্তি শক্ত রাখবেন।
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট নগরীকে একটি দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে নগরীর অনেক বাসিন্দা রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য নিজেদের মূল্যবান জমি বিনা মূল্যে ছেড়ে দেন, যা নগর উন্নয়নের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে নগরীর সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি ছিল ফুটপাত দখল করে হকারদের অবৈধ বাণিজ্য। আরিফুল হক চৌধুরী একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও এ সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রশাসনের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় প্রতিবারই তার অভিযান স্থায়ী হয়নি। ফলে সিলেটের প্রধান সড়ক ও ফুটপাতগুলোতে জনদুর্ভোগ থেকেই গেছে।
বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নগরবাসীর প্রত্যাশাকে পুঁজি করে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আবার মাঠে নেমেছেন। এবার তার লক্ষ্য শুধু অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা অপসারণ নয়, বরং দীর্ঘদিনের নাগরিক দুর্ভোগ—ফুটপাত দখলমুক্ত নগরী গড়ে তোলা। তার ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, আগের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার তিনি আরও সুপরিকল্পিত ও স্থায়ী সমাধান চান।
বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নগরবাসীর প্রত্যাশাকে পুঁজি করে আরিফুল হক চৌধুরী চান শুধু অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা অপসারণ নয়, বরং দীর্ঘদিনের নাগরিক দুর্ভোগ—ফুটপাত দখলমুক্ত নগরী গড়ে তোলা।

তবে এই উদ্যোগকে ঘিরে প্রশ্ন ওঠেছে। একটি পক্ষ বলছে, আরিফুল হক চৌধুরী বর্তমানে কোনো সরকারি দায়িত্বে নেই, তিনি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রও নন। তাহলে কোন আইনগত বা প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে তিনি হকার উচ্ছেদ কিংবা ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন? এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কি তিনি আদৌ অধিকৃত?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রশ্নগুলো কেবল প্রশাসনিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং আরিফুল হকের রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশল নিয়েও নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছে। সমালোচকরাও মনে করছেন, আরিফুল হক চৌধুরীর এই কার্যক্রম আসলে রাজনৈতিক কৌশল। নির্বাচনের আগে নগরবাসীর আস্থা অর্জন এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য জনমত তৈরিই তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তারা বলছেন, প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া এই ধরনের কর্মকাণ্ড আইনের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, “এটি আমার কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক অভিযান নয়। আমি বর্তমানে কোনো নির্বাহী দায়িত্বে নেই, তবে একজন সাবেক মেয়র ও নগরবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়াটা আমার নাগরিক দায়িত্ব। নগরের সমস্যা আমাদের সবার, তাই এ ধরনের দাবিতে যে কোনো সচেতন নাগরিক মাঠে নামতে পারেন।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমার এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো জনসচেতনতা তৈরি করা এবং প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। নগরবাসীর ভোগান্তি দূর করতে ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও অবৈধ যানবাহনের চলাচল বন্ধ করা জরুরি। যদি জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে এই দাবিগুলো তোলা না হয়, তবে প্রশাসনও সক্রিয় হতে দেরি করে।”

আরিফুল হকের ভাষায়, “নগর উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। আমি সেই দায়িত্ববোধ থেকেই কাজ করছি। এটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং সিলেটের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল নগরী গড়ে তোলার আন্দোলন।”

সব মিলিয়ে, আরিফুল হক চৌধুরীর ‘সিলেট সুন্দরের’ মিশন এখন দ্বিমুখী আলোচনার জন্ম দিয়েছে—একদিকে এটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন, অন্যদিকে আইনগত ও রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক।
আরিফুল হক চৌধুরী দুই দফায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। তার আমলে নগরীতে আধুনিকায়নের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হয়েছিল। সড়ক সংস্কার,ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন,
শহর সৌন্দর্যবর্ধন,বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ—এসব উদ্যোগে তিনি নগরবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
তবে সমালোচনা ছিল দুর্নীতি ও রাজনৈতিক চাপের অভিযোগ নিয়েও। তবুও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে তিনি একজন কর্মক্ষম ও দৃঢ় সিদ্ধান্তপ্রণেতা নেতা হিসেবে পরিচিত।
অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে তার সাম্প্রতিক উদ্যোগ নগরীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রশংসিত এবং সমালোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি আগামী মেয়র নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থিতা ঘোষণার ইঙ্গিত বহন করছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি, অনেকেই ধারণা করছেন তিনি শেষ পর্যন্ত সিলেট-১ আসন ছেড়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
সিলেট-১ আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী হলেন খন্দকার মুক্তাদির, যিনি খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। ফলে এই আসনে প্রার্থী হওয়া আরিফুল হকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তিনি সহজে বিজয় লাভ করবেন বলে মনে করছেন।
সিলেট বিএনপির ভেতরে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পাশাপাশি আরও একজন শক্তিশালী ও জনপ্রিয় মেয়র প্রার্থীর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি হলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বারবার নির্বাচিত কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র, একই সঙ্গে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, তৃণমূলভিত্তিক জনপ্রিয়তা এবং সংগঠনের নেতৃত্বে সক্রিয় ভূমিকা তাকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখছে বলে মনে করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
ফুটপাত ও হকার সমস্যার প্রসঙ্গে কয়েস লোদী বলেন, “সুশৃঙ্খল নগরী গড়ে তোলা এবং হকারমুক্ত ফুটপাত নিশ্চিত করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। জনগণকে এ সুবিধা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। লোক দেখানো অভিযান চালালে স্থায়ী কোনো ফল আসবে না।”
নগর উন্নয়ন প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও তিনি মন্তব্য করেন। তার ভাষায়, “এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য জাতীয় নির্বাচন। কীভাবে বিএনপি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেতে পারে, এ নিয়েই আমরা কাজ করছি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তার এই বক্তব্যে একদিকে দলের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিফলিত হয়েছে, অন্যদিকে নগর রাজনীতিতে নিজের সম্ভাবনাও স্পষ্ট করে তুলেছেন। ফলে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত রেজাউল হাসান কয়েস লোদী একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ হয়ে থাকবেন।

আরিফুল হকের সমর্থকরা মনে করছেন, আবারও আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র হলে নগর উন্নয়নের গতি ফিরবে। তিনি বর্তমানে যে কার্যক্রম চালাচ্ছেন তা নিঃসন্দেহে সিলেট নগর রাজনীতিকে নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
এক কথায়, “সিলেট সুন্দরের” মিশন ভবিষ্যতে সিলেট রাজনীতির একটি বড় মোড় ঘোরাতে পারে।

ডিএস/এমসি

Explore More Districts