মুহিত চৌধুরী: সিলেট এবং সুনামগঞ্জে চলছে ইতিহাসের ভয়াবহ বন্যা। দ্বিতীয় বন্যার মেয়াদ ২০ দিন অতিবাহিত হবার পরও পর সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে উন্নতি হয়নি। খুবই ধীর গতিতে পানি কমছে। পানি নেমে যেতে না পারায় বৃষ্টি হলেই সিলেট নগরী এবং এর আশপাশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
বিশেষজ্ঞ সিলেটে বন্যার পানি নামার ধীরগতিকে এই অঞ্চলের একটি স্থায়ী সমস্যার সংকেত বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, অবস্থার উন্নতি করতে না পারা গেলে প্রতি বছর সিলেট-সুনামগঞ্জে এ ধরণের ভয়াবহ বন্যা হবে। সিলেটে বন্যা প্রতিবছর কম বেশী হতো এবং বন্যার পানি মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে খুব দ্রুত চলে যেতো। কিন্তু এইবার বন্যার পানি নামার ক্ষেত্রে যে ধীর গতি দেখা যাচ্ছে অতীতে তা দেখা যায়নি।
সিলেট এবং সুনামগঞ্জে ভায়াবহ এই বন্যার দু’টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হলো প্রাকৃতিক অপরটি মানবসৃষ্ট।
১.প্রাকৃতিক : দীর্ঘ দিন থেকে উজান থেকে নেমে আসা পলিমাটি, বালি এবং পাথর নূড়ি পাথরের মাধ্যমে সুরমা, কুশিয়ারা, ধলাই, পিয়াইন, গোয়াইন, সারি ও লোভা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। এইসব নদীর নাব্যতা সংকট বন্যার অন্যতম কারণ।
২.মানবসৃষ্ট: এইবারের বন্যার প্রাকৃতিক কারণ থেকে মানবসৃষ্ট কারণ বেশি বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা। হাওরে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, নদীতে নানা ধরণের বর্জ্য ফেলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে।
অনেকেই কিশোরগঞ্জের একটি রাস্তাকে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হবার জন্য দায়ী করেছেন। তারা বলছেন অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এই রাস্তার জন্য সিলেট এবং সুনামগঞ্জবাসী বন্যার পানিতে ডুবছে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় বন্যার মূল কারণ হাওড়ের বুক চিরে ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ৭৭ কিলোমিটার রাস্তা। এরমধ্যে হাওড়াঞ্চলে রয়েছে ৩০ কিলোমিটার বাঁধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওড়ের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। কিন্তু ভুল সড়ক, ভুল বাঁধ আর অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিক্রিয়ায় পানি নামতে পারছে না বলে সহনশীল বন্যা দুঃসহ হয়ে উঠেছে।
বন্যার পানি নামতে ধীরগতির কারণ প্রসঙ্গে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সাধারণত সিলেটের পানি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালনী নদী দিয়ে ভৈরব হয়ে মেঘনায় গিয়ে মেশে। গত কয়েক দশকে কালনী ভরাট হয়ে পানিপ্রবাহের পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়েছে। ভরাট হয়েছে হাওরও। তাই এখন বৃষ্টিপাত কমে এলেও বন্যার পানি সহজে নামছে না। কালনীর উজানে পানি ফুলে ফেঁপে বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদের ভাষ্যমতে, আগে হাওরে যেভাবে পানি নামত, এখন সেভাবে নামছে না। সুনামগঞ্জের হাওরগুলোর যদি পানিধারণের ক্ষমতা আগের মতো থাকত, তবে সিলেটে পানি জমে থাকার সুযোগ পেত না। এ ছাড়া অনেক হাওর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি নামার সুযোগ না পেয়ে বন্যা দীর্ঘ হচ্ছে। ভবিষ্যতে বন্যার এ ভয়াবহতা এড়াতে সিলেটে নদী খনন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এই বন্যার জন্য ৩টি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তদেশীয় উদ্যোগের অভাব ও নিজেদের অব্যবস্থাপনা।
২১ জুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘আকস্মিক বন্যায় সিলেটে মানবিক বিপর্যয়: কারণ ও করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলেন বাপা এসব কথা জানায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) বৈশ্বিক সমন্বয়ক ও বাপার সদস্য মো. খালেকুজ্জামান বলেন, সিলেটে গত কয় দিনে যে বৃষ্টি হয়েছে, তা হওয়ার কথা নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটা হচ্ছে। এটা বৈশ্বিক কারণ। এই বৃষ্টি আরও বাড়বে।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে খালেকুজ্জামান বলেন, ভারতের আওতায় অনেক নদী আছে। মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তদেশীয় নদী আছে। কিন্তু একটির জন্যও পানি–পলি ব্যবস্থাপনা যৌথভাবে করার চুক্তি নেই। ভারত তাদের বাধ ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। যখন প্রয়োজন পানি ধরে রেখেছে। যখন প্রয়োজন খুলে দিয়েছে। যৌথ ব্যবস্থাপনায় গেলে পরিস্থিতি সামলানো যেত।
পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বেষ্টনী পদ্ধতির ব্যবহার, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, নদী দখল ও ব্যবস্থাপনার অনিয়ম, যত্রতত্র বালু উত্তোলনকে বন্যার তৃতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
পরিশেষে বলতে চাই, সিলেটে বন্যার কারণ যেটাই হোক এই সমস্যার সমাধান নিয়ে সরকারি উদ্যোগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বৈঠক করা জরুরী। আর এই বৈঠকের আলোকে সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। তাহলে সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ ভয়াবহ বন্যা থেকে রক্ষা পাবে। রক্ষা পাবে দেশের সম্পদ।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন