বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে সিলেট একসময় ছিল জ্ঞান, সংস্কৃতি ও মেধার কেন্দ্র। ঔপনিবেশিক যুগে এখানকার শিক্ষা বিস্তার এবং নাগরিক চেতনা গড়ে তুলেছিল এক অনন্য ধারা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই আলোকিত সিলেট আজ পড়েছে ভয়াবহ শিক্ষাগত বিপর্যয়ের মুখে। প্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষা, নবজাগরণের ধারায় উচ্চশিক্ষা বিস্তার, এবং প্রশাসনিক দক্ষতায় দেশজুড়ে সিলেটিদের নেতৃত্ব এক সময় ছিল গৌরবের প্রতীক। সেই সিলেটেই এখন দেখা দিয়েছে ভয়াবহ শিক্ষাগত বিপর্যয়।
চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার নেমে এসেছে ৫১ দশমিক ৮৬ শতাংশে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হারও কমেছে নাটকীয়ভাবে— গত বছর ৬,৬৯৮ জন জিপিএ-৫ পেলেও এ বছর পেয়েছে মাত্র ১,৬০২ জন।
ফলাফলের এই ধস শুধু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নয়, সিলেটের দীর্ঘ শিক্ষাগত ঐতিহ্যের ওপরও আঘাত হেনেছে।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে সিলেট ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র।
১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, ১৮৯২ সালে মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, এবং ১৯২০ সালে গঠিত সিলেট শিক্ষা বোর্ডের প্রাথমিক কমিটি— এই ধারাই পরে পূর্ববঙ্গের শিক্ষাজগতে নতুন আলোর সূচনা করে।
সিলেট থেকে উঠে আসা অসংখ্য ব্যক্তিত্ব জাতীয় প্রশাসন, বিচার বিভাগ, কূটনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষায় রেখেছেন অনন্য ভূমিকা—এমনকি বর্তমান প্রশাসনেও রয়েছে অসংখ্য সিলেটি কর্মকর্তা।
সিলেট অঞ্চলের সাক্ষরতার হার ছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ— ২০০০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সিলেট বিভাগের গড় সাক্ষরতার হার ছিল ৫৩.১ শতাংশ, যা তখনকার জাতীয় গড়ের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই ঐতিহ্য এখন বিপর্যয়ের মুখে।
বৃহস্পতিবার ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে— সিলেট বোর্ডে ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে ভয়াবহ ব্যর্থতা ঘটেছে। ইংরেজিতে পাসের হার মাত্র ৬৪.৫৩ শতাংশ, গত বছর ছিল শতভাগ।
আইসিটিতে পাসের হার নেমে গেছে ৮০.৮৭ শতাংশে, যা গত বছর ছিল ৮৭.৭৮ শতাংশ।
শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের বিশ্লেষণে ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে ছয়টি প্রধান কারণ:
১️. উত্তরপত্র মূল্যায়নে দুর্বলতা,
২️. প্রশিক্ষণবিহীন পরীক্ষক,
৩️. নিবন্ধিত শিক্ষক সংকট,
৪️. শিক্ষার্থীদের মোবাইল গেমসে আসক্তি,
৫️. বিদেশমুখী প্রবণতা,
৬️. ইংরেজি ভীতি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহ।
এ ব্যাপারে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন,
“এই ফলাফলই সিলেটের বাস্তব চিত্র। এখনো হাওরাঞ্চলে ইংরেজি শিক্ষকের অভাব প্রকট। অনেক প্রতিষ্ঠানেই যোগ্য শিক্ষক নেই। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার চেয়ে স্মার্টফোনে বেশি সময় ব্যয় করছে।”
তিনি আরও বলেন, “২০০৩-২০০৬ ও ২০২০ সালের ফলাফলগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, তখন ফলাফল কৃত্রিমভাবে ভালো রাখা হয়েছিল। এবারের ফলাফল বাস্তবতার প্রতিফলন।”
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাম্মদ হায়াতুল ইসলাম আখঞ্জি বলেন,
“সিলেট শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। এসএসসির পর এইচএসসিতেও ফল বিপর্যয় মানে এই অঞ্চলের শিক্ষায় গভীর সংকট। এখনই শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব প্রফেসর কবির আহমদ বলেন,
“সিলেটের শিক্ষার মান ধরে রাখতে হলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ জরুরি। বেডোর প্রশিক্ষণ প্রকল্প পুনরায় চালু করতে হবে।”
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেন,
“এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি বেড়েছে। শিক্ষা শুধুমাত্র বইয়ের বিষয় নয়, এটি মানসিক সম্পর্কের বিষয়ও।”
সিলেটের একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ও সিলেট লেখিকা সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক কবি ইশরাক জাহান জেলী বলেন,
“শিক্ষার্থীরা এখন ইউটিউব ও টিকটকের কাছে বেশি অনুগত। কলেজ আঙিনায় শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষকদের প্রেরণা ও অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে।”
অভিভাবক এমরান আহমদ চৌধুরী মোহন বলেন,
“করোনা-পরবর্তী ‘অটোপাস সংস্কৃতি’ এখনো অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে সক্রিয়। তারা ভাবে পড়াশোনা ছাড়াই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব— এটা ভয়াবহ মানসিক প্রবণতা।”
সিলেটিরা শুধু শিক্ষায় নয়, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেও নেতৃত্ব দিয়েছে।
বিগত দুই দশকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থসচিব, পররাষ্ট্রসচিবসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহু সিলেটি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন। কূটনীতিতেও সিলেটিদের উপস্থিতি সুদৃঢ়— জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রাক্তন স্থায়ী প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিযুক্ত ছিলেন সিলেটি কূটনীতিকরা।
এই বাস্তবতায় সিলেটের শিক্ষাক্ষেত্রের দুরবস্থা শুধু স্থানীয় নয়— এটি জাতীয় ক্ষতিরও প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিলেট শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্বল বিষয় চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
তবে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, “শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে হবে না, শিক্ষার্থীর মানসিকতা ও পরিবারিক পরিবেশেও পরিবর্তন আনতে হবে।”
এক সময় আলোকিত সিলেট আজ শিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত।
যে অঞ্চলের সন্তানরা প্রশাসন, কূটনীতি ও জ্ঞানচর্চায় দেশকে আলোকিত করেছে, সেই অঞ্চলের অর্ধেক তরুণ আজ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ফেল করছে— এটি শুধু সংখ্যার বিষয় নয়, এটি এক ঐতিহ্যের পতনচিত্র।
এখনই যদি শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার পরিবেশ পুনর্গঠন ও শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা কর্মসূচি চালু না করা হয়, তবে সিলেটের গৌরবময় শিক্ষাঐতিহ্য ইতিহাসের পাতায় পরিণত হবে— বর্তমানের নয়।