আপডেটঃ 11:34 pm | March 23, 2022
প্রদীপ ভৌমিক ॥ ময়মনসিংহ বাসীর প্রত্যাশা ছিল আজকের এই দিনটিকে স্মরণ করবে একজন২১ পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক কিংবা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত বীরের মহাপ্রয়াণ দিবস হিসেবে। দুঃখজনক হলেও সত্য তাকে দুইটি রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক পুরস্কারের একটিও অদ্যাবধি প্রদান করা হয়নি। দুর্ভাগ্য ময়মনসিংহবাসির অত্যান্ত সাদামাটাভাবে রফিকউদ্দিন ভুঁইয়ার একান্ত অনুগতদের দ্বারা উদযাপিত হল ময়মনসিংহের বীরপুরুষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাষা সৈনিক আওয়ামী লীগের অনেক লড়াই সংগ্রামের মহানায়ক রফিকউদ্দিন ভুঁইয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর আজকের দিনটি। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২সাল পর্যন্ত তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের প্রচণ্ড দাপট ও নির্যাতনের মাঝেও তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে ছিলেন ময়মনসিংহের অগ্রপুরুষ। ১৯৪৮ সালে তিনি আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহবায়ক নির্বাচিত হন। সেই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তখন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে সাথী হিসেবে সশরীরে উপস্থিত থেকে অপরাপর ভাষা সৈনিকদের সাথে তিনিও প্রতিবাদ করেছিলেন।১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহের বিপিন পার্কে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে যে ছাত্র-জনতার সভাটি অনুষ্ঠিত হয় সর্বপ্রথম তার সভাপতিত্ব করেন রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া। ২৮ শে ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অধিকাংশ সদস্য সহ রফিক উদ্দিন ভূইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন কারা অভ্যন্তরে এই বীর সেনানী কে সুদীর্ঘ আড়াই বছর আটকে রাখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ১৯৫৪ সাল থেকে হাজার ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ময়মনসিংহ টাউন হল ময়দানে স্বাধীনতাকামী জনতার সামনে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেছিলেন সর্বপ্রথম ,সেই ছাত্র জনতার সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছেন রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ছয় দফা আন্দোলনে যখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কারাগারে তখন কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য হিসেবে চিটাগাংয়ের লালদীঘি ময়দান সহ সারা বাংলাদেশে জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। পাকিস্তান আমলে রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া ছিলেন অবিভক্ত ময়মনসিংহের জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের রাজপথের মিছিলের নেতৃত্ব দানকারী সৈনিক। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রধান সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১১ নং সেক্টরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাকশাল গঠন কালীন সময়ে তিনি ময়মনসিংহ জেলার গভর্নর নিযুক্ত হন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুজিব হত্যার বিচার ও আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া। ১৯৭৩ সালে তিনি নান্দাইল ৯ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় ও ১৯৮৬ জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রাথমিক সময়ে রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া বাসভবনটি ছিল ময়মনসিংহ জেলার স্বাধীনতাকামী জনগণের কন্ট্রোল রুম। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকে যে সেই কন্ট্রোল রুম থেকে ময়মনসিংহের আরেক বীর সেনানী ময়মনসিংহ আ: লীগের দুঃসময়ের প্রাণপুরুষ সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দায়িত্ব পালন করেছেন। রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া ছিলেন একজন সৎ নির্ভীক রাজনৈতিক কর্মী। জনশ্রুতি আছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সোনালী ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা রফিক উদ্দিন এর কাছে জমা ছিল। রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া সেই টাকার একটিও খরচ করেন নাই নিজের জন্য , যা জমা দিয়ে দিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে। স্বাধীন বাংলাদেশ একসময়ের এই অশেষ ক্ষমতাশালী নির্লোভ ব্যক্তিটি তার বার্ধক্য কালীন সময়ে অসুস্থ অবস্থায় নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগেছেন যা ময়মনসিংহবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ময়মনসিংহবাসী মনে করে উনার মত এত বড় মাপের একজন নেতা ইচ্ছে করলে আজকের নেতাদের অনেকের মত কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতা যা আজকের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ময়মনসিংহ বাসী মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উচিত তাকে ভাষা সৈনিক হিসেবে একুশে পদক কিংবা একজন সৎ নির্লোভ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা । অথচ ভাষাসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া এ সম্মান থেকে আজও বঞ্চিত। স্বাধীনতার পক্ষের সরকারে নিকট ময়মনসিংহের জনগণের প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগের সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ্দিন ভূইয়া কে রাষ্ট্রীয় পদক প্রদান করে সম্মান প্রদর্শন করবে। সর্বশেষ আরেকটি কথা বলে উনার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি, হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তার দোসরদের হাত থেকে ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ক্যাম্পে যখন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন তখন সেই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া।