সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ বছরে এক লাখ ১৬ হাজার মৃত্যু

সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ বছরে এক লাখ ১৬ হাজার মৃত্যু

সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ বছরে এক লাখ ১৬ হাজার মৃত্যু

দেশের সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা কাটছে না। লাফিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু। সড়ক দাপিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ অবৈধ যানবাহন চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা ঠেকাতে পারছে না। সড়ক নিরাপত্তা টাস্কফোর্স, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলসহ সব সরকারি উদ্যোগ অকার্যকর। গত ১৫ মাসে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো নিয়ে একটি সভাও হয়নি। এ পরিস্থিতিতে আজ বুধবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’। কিন্তু দেশের সড়কের বাস্তব চিত্র বলছে উল্টো। সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যানে দীর্ঘ হচ্ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল।

গতকাল মঙ্গলবার যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক যুগে দেশে ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন। গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন ২৭ জন এবং আহত হচ্ছেন ৩৮ জন।

শুধু ২০২৩ সালেই সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯ জন মারা যান। ২০২৪ সালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৫৪৩-এ। অর্থাৎ এক বছরে মৃত্যু বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত ও ৯৬৪ জন আহত হয়েছেন।

তবে সরকারি সংস্থা বিআরটিএর তথ্য কিছুটা ভিন্ন। তাদের হিসাবে ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২৪ জন নিহত হন। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ৫ হাজার ৩৮০-তে দাঁড়ায়। গত সেপ্টেম্বর মাসেই ৪৩৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪০৯ জনের ও আহত হয়েছেন ৪৫৫ জন। গত সোমবার এক দিনেই সারাদেশে ছয়টি দুর্ঘটনায় ৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন; আহত হয়েছেন একজন।

মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালক
বিআরটিএর তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশে ২০ ধরনের ৬৫ লাখ ৭ হাজার ২৮১টি গাড়ি চলাচলের জন্য নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত রোড সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৫ লাখের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলছে, যার প্রায় ৭০ শতাংশ এখনও সড়কে সক্রিয়। এসবের মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই রয়েছে ১০ হাজারের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। বিআরটিএর নিজস্ব প্রতিবেদনেও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা এই বেসরকারি সংস্থার কাছাকাছি।

সংস্থাটির দাবি, এসব ফিটনেসবিহীন ও অননুমোদিত গাড়িই অধিকাংশ দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ছাড়া গণপরিবহনে নারী যাত্রীরা ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এক জরিপে দেখা যায়, ৮৩ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার।

বিআরটিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ১৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট ৩৮৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। এতে ২ হাজার ৬১৮টি মামলায় ৬৫ লাখ ২১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কারাদণ্ড হয়েছে ১৩ জনের ও ৩৬৪টি গাড়ি ডাম্পিং করা হয়েছে।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার এক দিনেই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে এক হাজার ৮৪৬টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩৭৯টি গাড়ি ডাম্পিং ও ১১৬টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতিতে সড়কে বিশৃঙ্খলা
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, স্বাধীনতার আগে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ নৌ ও রেলপথে চলাচল করতেন; সড়কপথে মাত্র ২০ শতাংশ। ফলে দুর্ঘটনা ছিল সীমিত। কিন্তু স্বাধীনতার পর এখন ৮০ শতাংশ মানুষ সড়কপথে চলাচল করছেন এবং দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। সে কমিটি সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে ১১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। আদৌ তা বাস্তবায়ন হয়নি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি হয়েছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অনুমোদন, লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক নিয়োগ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার পরিবর্তন হলেও সড়ক, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার নিবন্ধন চালু করা হলে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো অচল হয়ে পড়বে।

ব্যাটারিচালিত রিকশায় ভোগান্তি
বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ৪৮ থেকে ৫০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে। এর মধ্যে বেশি চলে রাজধানীতে। ঢাকায় গত কয়েক বছরে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। একসময় বেশির ভাগই চলত মহল্লার রাস্তায়। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশবিহীন প্রধান অনেক সড়কে উঠে আসে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দরের টার্মিনাল এলাকায়ও দেখা গেছে এসব চলতে। সরকার ও আদালত কয়েকবার চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারেননি। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ লক্ষ্যে দুই সিটি করপোরেশন চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। তবে সরকারিভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমোদনে সড়কে আরও বিশৃঙ্খলা বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধনের উদ্যোগে এক বছরের মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর অচল হয়ে পড়বে।

সড়ক সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি
রোড সেফটি নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক পাহাড়ি ভট্টাচার্য বলেন, দেশে দীর্ঘ ৫৪ বছরেও টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন হয়নি। সড়ক অবকাঠামো দুর্বল, সমন্বয়ের অভাব প্রবল। জবাবদিহির অভাবে সড়ক পরিবহন খাত ভেঙে পড়েছে। সড়ক পরিবহন খাতে কোনো সংস্কার কমিশন হয়নি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক সমকালকে বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে যাদের যে কাজ, তারা সেটি করছেন না। রুট পারমিটের নামে শুধু ব্যানার বিক্রি চলছে। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সড়ক থেকে তুলে দিতে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না।

Explore More Districts