দেশে ধান উৎপাদনে বোরো মৌসুম বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়েছে আবাদ। তবে লক্ষ্মীপুরে মৌসুমের শুরুতেই সেচ সংকটে পড়েছেন বোরো চাষিরা। সেচ প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা ও খালগুলোয় পানি না থাকায় সময়মতো চারা রোপণ করা যাচ্ছে না। অনেক জমি এখনো আবাদ হয়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু সেচ দিলেও সার-কীটনাশকসহ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষক।
স্থানীয়রা জানায়, ধান উৎপাদনে লক্ষ্মীপুর স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সেচ সংকটে বোরো আবাদের অর্ধেকের বেশি জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। মোনহরপুর কৃষি সমবায় সমিতি, দত্তপাড়া কৃষি সমবায় সমিতি, চরচামিতা, উত্তরজয়পুরসহ বেশ কয়েকটি কৃষি সমবায় সমিতির আওতায় গভীর নলকূপ ও খালভিত্তিক সেচপ্রকল্পগুলো অকেজো থাকায় ব্যাহত হচ্ছে বোরো আবাদ। খালগুলো দ্রুত সংস্কার ও সেচ প্রকল্পগুলো পুনরায় চালু করা গেলে বোরো আবাদসহ কৃষি উৎপাদনে এ অঞ্চল স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ধান উৎপাদনে মোট সেচের ৯৩ শতাংশ প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। সেচনির্ভর বোরো ধান চাষে জমির প্রকারভেদে ১৫-৩০ বার সেচ দিতে হয়। এতে ধানের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়। বিপুল পরিমাণে পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। তবে বোরো আবাদে সেচ সংকট নিরসনে কাজ করছে কৃষি অফিস।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, জেলায় ১১টি গভীর নলকূপ, ২ হাজার ৬১৪টি অগভীর নলকূপ ও ২ হাজার ৬৩৯ লো-লিট সেচ পাম্প রয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪৭ টন।
বিজ্ঞাপন
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সোহেল মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ফিরোজ বলেন, ‘প্রতিবারই বোরো মৌসুমে পানি সংকট দেখা দেয়। মূলত পার্শ্ববর্তী জেলা চাঁদপুর ইরিগ্রেশন প্রজেক্ট থেকে সময়মতো পানি না আসায় এ সংকট দেখা দেয়। হাজীগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জে মৎস্য চাষির সমস্যাসহ কিছু জটিলতায় পানি পেতে কিছুটা সময় লাগে। তবে বিষয়টি নিয়ে চাঁদপুর পান্নি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। তাছাড়া জেলার খালগুলো সংস্কার করা হলে দ্রুত এ সংকট নিরসন করা সম্ভব। এবার বীজতলা বেশি হওয়ায় সেচ সংকট বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তেমন প্রভাব ফেলবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ, উত্তর জয়পুর ইউনিয়ন, দিঘলী ও চরশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় সেচ প্রকল্পগুলোর অব্যবস্থাপনা ও খালে পানির অভাবে বোরো কয়েকশ একর জমি আবাদ হয়নি।
কৃষকরা বলছেন, পৌষের শুরুতে বোরো আবাদের কথা থাকলেও সেচের অভাবে মাঘ মাসেও চারা রোপণ করতে পারেনি তারা। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু এলাকায় সেচের ব্যবস্থা করা হলেও সার-কীটনাশকসহ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
সদর উপজেলার গণিপুর গ্রামের কৃষক আবুল বাসার ও কালামিয়া জানান, সার-কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা। ৫০ শতক জমিতে বোরো আবাদ করতে বর্তমানে খরচ হবে ৩৫-৪০ হাজার টাকা। সে হিসাবে মণপ্রতি ২ হাজার টাকা উৎপাদন ব্যয় হলে বাজারে বিক্রি করতে হয় ১ হাজার ৪০০ টাকা। এতে এমনিতেই লোকসান গুনতে হয় তাদের। তার ওপর শ্যালোমেশিনে পানি তুলে বোরো আবাদ করলে লোকসান আরো বাড়বে। তাই বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক এবার জমি খালি রেখে দিয়েছেন।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে লক্ষ্মীপুর জেলায় পুরোদমে বোরো আবাদ শুরু হয়। তবে সেচ সংকটে জানুয়ারির শেষেও চারা রোপণ শুরু করতে পারেননি অনেক কৃষক। সময়মতো গভীর নলকূপগুলো চালু না করা এবং রহমতখালী, মহেন্দ্র, ওয়াপদাসহ জেলার বড় বড় খালে পানি না থাকায় সংকট আরো তীব্র হয়েছে। খালভিত্তিক সেচ প্রকল্পগুলোও যথাসময়ে চালু করা হয়নি। এতে বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পাঁচপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল হান্নান ভূঁইয়া জানান, ২০০৪ সালের সুনামিতে ভূগর্ভস্থ পানির পাইপ লাইন নষ্ট হয়ে যায়। লক্ষ্মীপুর সদরের চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব পাঁচপাড়া কৃষক সমবায় সমিতির পদ্মা, মেঘনা ও সুরমা নামে তিনটি গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে যায়। চুরি হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ পাম্পসহ যন্ত্রাংশ। নলকূপ তিনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই গ্রামের শত শত কৃষক ধান চাষের জন্য খালের ওপর নির্ভরশীল। এবার সময়মতো সেচের পানি না পাওয়ায় ৪০০-এর বেশি একর জমিতে বোরো আবাদ হয়নি এখনো। নলকূপ তিনটি পুনরায় চালু করতে বার বার কেন্দ্রীয় সমিতির কার্যালয়ে ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির (বিআরডিবি) চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের অচল নলকূলগুলো সচল করতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে চলতি বোরো মৌসুমে বন্ধ সেচ প্রকল্পগুলো এখনই সচল করা সম্ভব নয়। কৃষকরা যেন যথা সময়ে চাষাবাদ করতে পারেন, সেজন্য সমিতির কর্মকর্তারা কাজ করছেন।’