মিসু সাহা নিক্কন, রামগতি: লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় উপজেলা রামগতির এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘদিন ধরে পদগুলো শূণ্য থাকায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে পাঠদানসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, এ উপকূলীয় উপজেলায় ৯৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূণ্য। তাদের দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন সহকারী শিক্ষকরা। অন্যাদিকে আগামী ৩০ জুনে আরো ৫ জন প্রধান শিক্ষক অবসরে চলে যাবেন।
প্রধান শিক্ষক না থাকায় সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে মানতে চান না বলে অভিযোগ একটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর বাবা মো. আরজু আমিনের।
সম্প্রতি উপজেলার কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে দেখা যায়, সহকারী শিক্ষকেরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে এসব বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিদ্যালয় পরিচালনার কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
মধ্য চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষক মো. আবু সায়েদের সঙ্গে। তিনি সমকালকে বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। বিগত ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত নেই, এর মধ্যে ২০১৬ সালে এক বছরের জন্য এসেছিলেন প্রধান শিক্ষক। আমি এ বিদ্যালয়ে গত ২০১৯ সালে যোগদানের পর থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমাকে প্রশাসনিক কাজে উপজেলা সদরে প্রায় দিনই দৌড়তে হয়। ফলে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে পারি না।
এই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রধান শিক্ষক না থাকায় পড়াশোনার মানোন্নয়ন ঠিকমত হচ্ছে না অন্যদিকে বিদ্যালয় পরিচালনায়ও সমস্যা হচ্ছে।
প্রধান শিক্ষক না থাকায় ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে পূর্ব চর মেহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাফায়েত উল্যাহ বলেন, গত চার বছর ধরে আমি ভারপ্র্প্তা প্রধানের দায়িত্ব পালন করছি। এজন্য আমাকে দাপ্তরিক কাজে যেতে হয়। অংশ নিতে হয় ট্রেনিং ও ক্লাষ্টারসহ বিভিন্ন মিটিংয়ে। তখন তিনি ক্লাস নিতে পারেন না। বাকি সহকারী শিক্ষককে সামলাতে হয় পুরো বিষয়।
চর গোসাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক মো. নূরনবী বলেন, শহর এলাকায় স্কুলগুলোতে অবসরের কারণে পদ শূন্য হলে অন্য এলাকা থেকে বদলি হয়ে পদ পূরণ হয়। কিন্তু চরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে অবসরে যাওয়ার পর পদ শূন্যই থেকে যাচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছরই বাড়ছে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য স্কুলের সংখ্যা।
উত্তর পূর্ব চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, শিক্ষক সঙ্কটের কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদানসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। উপকূলের এ সমস্যা দ্রুত নিরশন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষকের পদগুলো ৬৫ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৩৫ ভাগ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণের বিধান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। তাই প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। এছাড়া উপজেলার ৯৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৪ সহকারী শিক্ষকের পদও শূন্য রয়েছে। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানসহ শিক্ষা কার্যত্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
এ উপকূলীয় উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক শূণ্য থাকা বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে, চর পোড়াগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর আবদুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর সেভেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর সেকান্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর নেয়ামত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম বালুর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর আলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর আলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর মেহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর গোসাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর রমিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামগতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বড়খেরী এ.এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বড়খেরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর পল্লীমঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর গাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর আফজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর লক্ষ্মী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর গাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পশ্চিম রঘুনাথপুর হাজিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর রমিজ দক্ষিণ পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর নেয়ামত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর আফজল আদর্শপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য চর আফজল (২) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর চর মেহার মাস্টারপাড়া এ.কিউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চর সীতা মোল্লপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চর হাসান হোসেন গোলাম রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প: উ: চর আলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর মেহার মাষ্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব চর গোসাই হাজী নুরুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লোকমান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চর দরবেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এ উপকূলীয় উপজেলার মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চর আবদুল্যা ইউনিয়নের দক্ষিণ চর আবদুল্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত নেই প্রধান শিক্ষক। অন্যদিকে সহকারী শিক্ষকও সঙ্কট। দুর্গম চরাঞ্চলের কারণে ওখানে শিক্ষকরা যেতে যান না বলে দাবী সংশ্লিষ্ট দপ্তরের।
আ স ম আবদুর রব সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও চর আবদুল্যাহর বাসিন্দা মো. সাদ্দাম হোসেন জানান, শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে চরের শিশুদের জন্য কাজ করার সময় এখনি। কারণ, শিশুরা সব সময় তাঁদের অধিকার ও সুবিধাপ্রাপ্তির দাবি রাখে। এ কারণে চরের মানুষের দারিদ্র্য মূল মূল-ভূখন্ডের মানুষের চেয়ে বেশি। এ চরে পর্যাপ্ত স্কুল না থাকায় যৌতুক ও বাল্যবিবাহ বেশি। এখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার ও এনজিওগুলোকে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে কাজ করা খুবই জরুরি।
চর আবদুল্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও অভিভাবক মো. নোমান চৌকিদার জানান, এ চরে রয়েছে মাত্র দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল কিন্ত তা এখন বন্ধ। দক্ষিণ চর আবদুল্যা ও চর সেভেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে শিক্ষক সঙ্কট। দুর্গম চর হওয়াতে সকল শিক্ষকরা আসেন না নিয়মিত। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষকের পদ রয়েছে দীর্ঘ বছর ধরে শূণ্য।
দক্ষিণ চর আবদুল্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. রাজীব বলেন, প্রাক প্রাথমিক শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৯জন, ১ম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩০জন, ২য় শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৭ জন, ৩য় শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩২জন, ৪র্থ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ১৯ জন এবং ৫ম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ১২জন। এরমধ্যে বালক ৬৮ এবং বালিকা ৯১ জন। এ বিদ্যালয়ে ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে মাত্র ৩ জন।
চর সেবেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বিদ্যালয়ে কখনো প্রধান শিক্ষক এসেছিল কিনা তা আমার জানা নেই। চরের এ বিদ্যালয়ে ১৫৬জন শিক্ষার্থী রয়েছে। উপস্থিতি ৬০% থাকলেও নানা কারণে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
উপজেলা সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু সায়েদ বলেন, ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূণ্য থাকায় সহকারী শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করছেন। মুশকিল হলো, অনেক ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত এই প্রধান শিক্ষকদের আদেশ-নির্দেশ মানতে চান না অন্য শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, শূণ্য পদ পূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। শিক্ষকরা পদোন্নতি পেলে দ্রুত পদায়ন করা হবে।
মিসু সাহা নিক্কন/বার্তা-12-23