মৃত ও ভারতীয় নাগরিককে ভোটার রেখে ও ফ্যাসিবাদের ভোটার তালিকা দিয়েই সাহিত্য একাডেমির নির্বাচন হতে যাচ্ছে শনিবার(৩১ মে)। ইতোমধ্যে মহাপরিচালক-পরিচালক ও সদস্যদের অনেকে কোন প্রতিদ্বন্ধিতা ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। সাহিত্য একাডেমির বিতর্কিত নির্বাচন চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় মৃত ভারতীয় নাগরিক ও ভোটার নিয়ে এবং গঠনতন্ত্র পরিপন্থীভাবে ৩১ মে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শুরু থেকেই গঠনতন্ত্র পরিপন্থী এবং বিতর্কিত ভোটার তালিকা দিয়ে সাহিত্য একাডেমী কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচনের আয়োজন করে আসছে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে চাঁদপুর বৈষম্য বিরোধী লেখক সমাজের ব্যানারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ, সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি ও চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
চূড়ান্ত ভোটার তালিকা, নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচনী তফসিল প্রদান ছাড়া চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির গঠনতন্ত্র পরিপন্থীভাবে গত ১৬ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী কার্যনির্বাহী কমিটি গঠনের জন্য সাধারণ সভা আহবান করা হয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী লেখক পরিষদের আন্দোলন এবং উপস্থিত কয়েকজন ভোটার সদস্যদের আপত্তির কারণে ঐ সময় গঠনতন্ত্র পরিপন্থী অবৈধ পন্থায় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন থেকে বিরত থাকেন সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি ও চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক। ঐ সভায় জেলা প্রশাসক ১৫ দিন পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক ও সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি ২১ মে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে সাহিত্য একাডেমির চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে তিন সদস্য নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনার ৩১ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন… পতিত আওয়ামী লীগ চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীকে যেভাবে ফ্যাসিবাদী প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে
কিন্তু জেলা প্রশাসক কর্তৃক ২১ মে স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় প্রতিষ্ঠাতা ভোটার সদস্য নং ( ৯) মরহুম মোহাম্মদ হোসেন খানকে ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ তিনি ২৬ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়াও সাধারণ সদস্য ভোটার নং (২৪) অজয় কুমার ভৌমিক। তিনি দীর্ঘদিন থেকে একজন ভারতীয় নাগরিক। গঠনতন্ত্র অধ্যায়-এক (২) অনুযায়ী চাঁদপুরের স্থায়ী বাসিন্দগন চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সদস্য ভোটার হবেন। যার জন্য তিনি অবৈধ ভোটার।
চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর গঠনতন্ত্রের অধ্যায় ১০ এর ধারা ৩৫ (খ) অনুযায়ী নির্বাচন করতে গেলে অন্তঃত ৬০ দিন পূর্বে নির্বাচন কমিশন গঠনপূর্বক চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে হবে। অথচ জেলা প্রশাসক বিতর্কিত ভোটার তালিকা দিয়ে ২১ মে ২০২৫ খ্রি: তারিখে জারিকৃত আদেশে ৬০ দিনের স্থলে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে ১৫ দিন পূর্বে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেন এবং নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। উক্ত নির্বাচন কমিশনকে ০৫ জুন ২০২৫ খ্রি: তারিখের মধ্যে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য আদেশ দেন। নির্বাচন কমিশন ২১ মে ২০২৫ খ্রি: তারিখে তড়িঘড়ি করে ৩১ মে ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেন।
২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো: ইসমাইল হোসেন। ঐ সভায় ১৪১ জন ভোটার সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের উপস্থিতিত ভোটে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচন করা হয়। ৩০ জুন ২০২২ খ্রি: তারিখে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাদাত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় তার সময়ের দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় ১৪১ জন সাধারণ সদস্যের পূর্ণ তালিকা জেলা প্রশাসক ও সাহিত্য একাডেমী সভাপতি বরাবর হস্তান্তর করেন।
কিন্তু ২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ সরকারের সময়ে ডা: দীপু মনির দালাল ও চাটুকার হিসেবে স্বীকৃত ডা: পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে মহাপরিচালক বানানোর গোপন মিশন বাস্তবায়ন করতে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্দেশে জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান এক অফিস আদেশে ডা: পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে অন্যতম সদস্য করে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর একটি অর্ন্তর্বতীকালীন কমিটি গঠন করেন। ঐ কমিটিকে ৩ মাসের মধ্যে সাধারণ সদস্য তালিকা চূড়ান্ত করে নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আদেশে উল্লেখ করেন। ঐ কমিটির সব কার্যক্রমে সদস্য হিসেবে ডা: পীযূষ কান্তি বড়ুয়া একক আধিপত্য বিস্তার করে। ঐ বিতর্কিত অর্ন্তর্বতীকালীন কমিটি ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সাধারণ সভায় যেসব স্থায়ী সদস্যরা উপস্থিত থেকে ভোট দিয়ে কার্যকরী পরিষদ কমিটি নির্বাচন করেছে এবং সাহিত্য একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাদাত ২০২২ সালের ৩০ জুন তার সময়ে দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় যে ১৪১ জন সাধারণ সদস্যের পূর্ণ তালিকা হস্তান্তর করেন। সেসব সদস্য থেকে সম্পূর্ণ অগঠনতান্ত্রিক ও বেআইনিভাবে ভিন্ন মত এবং ডানপন্থী প্রায় একশত ভোটার সদস্যকে বাদ দিয়ে দেয়।
সাহিত্য একাডেমীকে আওয়ামী দোসরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পতিত আমলীগ সরকারের সময় মাত্র এক মাসের মধ্যে প্রায় ৭০ জন নতুন ভোটাধিকার সদস্য চূড়ান্ত করে। যাদের অনেকেই সাহিত্যকর্মের সাথে জড়িত নয়।
অথচ সাহিত্য একাডেমির গঠনতন্ত্রের অধ্যায়- (দুই) অনুযায়ী একজন প্রাথমিক সদস্যকে ভোটাধিকার সদস্য হতে হলে এক বছর সময় লাগে। ধারা ১১(খ) অনুযায়ী ‘যাহারা সুলেখক বা যাহাদের স্থানীয় ও আঞ্চলিক ভিত্তিতে বা জাতীয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের প্রমাণ বা খ্যাতি রহিয়াছে অথবা যাহার অতীতে যথেষ্ট সাহিত্য সেবামূলক সৃজনশীল কাজকর্মের প্রমাণ রাখিতে সক্ষম হইয়াছেন কেবলমাত্র তাহাদিগকে প্রাথমিক সদস্যে অন্তর্ভুক্তির সর্বশেষ ৩০ দিনের মধ্যেই সাধারণ সদস্য অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেয়া হইবে।’
কিন্তু নতুন তালিকায় এক মাসের মধ্যে গঠনতন্ত্র চরমভাবে লংঘন করে অনেক আনখোড়া নতুন সদস্য নেওয়া হয়েছে। যারা কোন ভাবেই সুলেখক হিসাবে পরিচিত নয়। অথচ, বর্তমান ভোটার তালিকায় স্থান পেয়েছে।
এভাবে একটি বিতর্কিত ভোটার সদস্য তালিকা প্রস্তুত করে ডা: পীযূষ কান্তি বড়ুয়াকে মহাপরিচালকসহ আওয়ামী দোসরদের দিয়ে কমিটি করার চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছার পর জুলাই বিপ্লব আন্দোলনের ফলে আর সম্ভব হয়নি।
জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিতর্কিত ভোটার সদস্য দিয়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশের বর্তমান চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ও সাহিত্য একাডেমীর সভাপতিকে অবৈধ ও বেআইনভাবে নির্বাচন না করার জন্য এবং বিতর্কিতদের বাদ দেওয়ার জন্য একাধিক আবেদন স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও ভোটার তালিকা হালনাগাদ না করে মৃত ও বিদেশী ভোটার রাখাসহ গঠনতন্ত্র পরিপন্থী ভাবে অবৈধ নির্বাচনের আয়োজন করায় বৈষম্য বিরোধী লেখক সমাজ ও চাঁদপুরের সচেতন মহলের কাছে ক্ষোভ বিরাজ করছে। মৃত সদস্যকে ভোটার করায় অনেক হাস্যরস ও বিস্ময় তৈরি হয়েছে।
৩৬ জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ের ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশে সাহিত্য একাডেমীর এই বিতর্কিত নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
স্টাফ করেসপন্ডেট, ২৯ মে ২০২৫