মিষ্টি কথার বিষ : পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বিচারিতার বিপদ!

মিষ্টি কথার বিষ : পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বিচারিতার বিপদ!

মিষ্টি কথার বিষ : পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বিচারিতার বিপদ!

দ্বিচারিতা ও মুখোশের মানুষ: মিষ্টি বিষের বাস্তবতা: 
এই ধরনের মানুষরা সাধারণত খুব আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলে, আপন করে নেয়, প্রশংসার চাদরে ঢেকে দেয় বাস্তব সত্যকে। কিন্তু এই কথার ভিতরেই লুকিয়ে থাকে বিভাজনের বিষ। তারা কখনো সরাসরি আঘাত করে না, বরং ধীরে ধীরে এমন এক মানসিক বিষ ছড়ায়, যা পারস্পরিক সম্পর্কের শিকড়কে ধ্বংস করে দেয়। কথায় আছে, “বিষ যদি ঢালে হাসিমুখে, তা সর্পের ছোবলের চেয়েও ভয়ানক।”

পারিবারিক কাঠামোতে বিষাক্ত মধু:
একটি পরিবার যখন একান্নবর্তী হয়, তখন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং সহযোগিতা পরিবারকে দৃঢ় করে। কিন্তু নতুন কোনো সদস্য বা পরিস্থিতির প্রভাবে যখন কারো মধ্যে স্বার্থপরতা জন্ম নেয়, তখনই শুরু হয় সম্পর্ক ভাঙনের সূচনা। বউ-শাশুড়ি, ভাই-ভাই, মা-ছেলে কিংবা পিতা-কন্যার সম্পর্কেও এই মধুর কথার আড়ালে জন্ম নেয় সংশয়, অবিশ্বাস ও মনোকষ্ট। পারিবারিক বন্ধনের ছেদ তখনই ঘটে যখন কোনো একজন গোপনে বিষ ছড়াতে থাকে — মুখে মধু, মনে বিষ।

সামাজিক প্রেক্ষাপটে দ্বিমুখী চরিত্র :
সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা সামনাসামনি সদয়, সহানুভূতিশীল – কিন্তু পেছনে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। এরা কাদা ছোঁড়ে নরম হাতে, আগুন ধরায় হাসিমুখে। এর ফলে গড়ে ওঠে এক ধরনের সামাজিক অবিশ্বাস, যেখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। এই সন্দেহ সামাজিক বন্ধনকে ক্ষীণ করে তোলে এবং সমাজের একতা দুর্বল হয়ে পড়ে।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় মুখোশধারীদের প্রভাব:
রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এই দ্বিচারিতা এক গুরুতর সমস্যা। মিষ্টি কথা বলে জনসমর্থন আদায় করে যারা পরে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তারাই রাষ্ট্রের মূল কাঠামোতে ফাটল সৃষ্টি করে। তারা বলে “জনসেবায় আছি”, অথচ অন্তরে লালন করে ‘স্বার্থসেবার’ রাজনীতি। এতে জনআস্থা হারায়, আইন ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভেঙে পড়ে। একজন দুর্নীতিবাজ নেতার চেয়ে ভয়ংকর সেই নেতা, যে স্বচ্ছতার কথা বলে অন্ধকারকে আরও ঘন করে।

প্রতিরোধ ও আত্মশুদ্ধির পথ: 
এইসব বিষাক্ত চরিত্র থেকে সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হলে আগে আমাদের নিজেদের আত্মসমালোচনার জায়গায় দাঁড়াতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে — কাকে আমি বিশ্বাস করছি, কার কথায় আমি প্রভাবিত হচ্ছি, এবং সেই বিশ্বাসের ভিত্তি কতটা দৃঢ়। সচেতন না হলে, পরবর্তী ধ্বংস অনিবার্য।

শুধু অন্যকে নয়, নিজেকেও প্রশ্ন করতে হবে — “আমিও কি এমন মিষ্টি বিষ ছড়িয়ে চলেছি না তো?” এই আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই আসবে আত্মশুদ্ধি।

উপসংহার: 
ঐক্য, সততা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতাই মুক্তির পথ:

পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আমরা যদি সত্যিকারের ঐক্য, আন্তরিকতা ও সততার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি, তাহলে এই বিষাক্ত মুখোশধারীদের প্রভাব অনেকটাই প্রতিহত করা সম্ভব। প্রতিটি মানুষকেই হতে হবে এক একজন আত্মনিরীক্ষক। তাহলেই পারিবারিক শান্তি, সামাজিক স্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় সুদৃঢ়তা নিশ্চিত হবে।

আমরা যেন ভুলে না যাই — “ভাতারের খায়, নাং-এর কোলে শুয়ে ঘুমায়” — এদের ঠেকাতে হলে মুখ নয়, মন পড়তে শিখতে হবে।
 

Explore More Districts