মানবিক নগর ব্যবস্থাপনার নতুন চিন্তা: সিলেটে ‘হলিডে মার্কেট’

মানবিক নগর ব্যবস্থাপনার নতুন চিন্তা: সিলেটে ‘হলিডে মার্কেট’

মানবিক নগর ব্যবস্থাপনার নতুন চিন্তা: সিলেটে ‘হলিডে মার্কেট’সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট নগরীতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে রাজপথ ও ফুটপাত দখলমুক্ত অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে দীর্ঘদিনের দখলমুক্ত রাজপথ ফিরে পেয়েছে নগরবাসী, কিন্তু জীবিকার সন্ধানে থাকা শত শত হকার এখন বেকার ও দিশেহারা। তাদের পুনর্বাসনের জন্য লালদিঘীরপার এলাকায় হকার মার্কেট চালু করা হলেও, তা পর্যাপ্ত নয়।
এই বাস্তবতায় একটি মানবিক ও আধুনিক নগর ধারণা হলো—‘হলিডে মার্কেট’। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার থেকে চৌহাট্রা পর্যন্ত সড়কটিতে প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ রেখে ‘হলিডে মার্কেট’ বসানো যেতে পারে। ওই সময়ে বিকল্প সড়কে যানবাহন চলবে, আর নির্দিষ্ট এলাকাটি পরিণত হবে নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে।

পৃথিবীর বহু উন্নত শহরে এমন অস্থায়ী মার্কেট বহুদিন ধরেই চালু রয়েছে। ইউরোপের লন্ডন, আমেরিকার নিউইয়র্ক, ফ্রান্সের প্যারিস, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক কিংবা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর—সবখানেই “হলিডে মার্কেট” বা “ফ্লি মার্কেট” জনপ্রিয় নাগরিক সংস্কৃতির অংশ। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে তরুণ উদ্যোক্তা—সবাই অল্প মূলধনে তাদের পণ্য বিক্রি করেন। সময় শেষ হলে নগর কর্তৃপক্ষ বাজার এলাকা পরিষ্কার করে, রাস্তা আবার সাধারণ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়।
এই পদ্ধতি শহরের অর্থনীতি যেমন সচল রাখে, তেমনি নাগরিক ও প্রশাসনের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সংস্কৃতিও গড়ে তোলে।

সিলেট একটি অভিবাসী অধ্যুষিত, দ্রুত বর্ধনশীল নগরী। প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ জীবিকার জন্য এখানে আসেন। উচ্ছেদ অভিযানের পর অনেকেই পেশা হারিয়েছেন। শহরের প্রধান সড়কে অনিয়ন্ত্রিত হকারের কারণে যানজট ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হলেও, তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকলে সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান সম্ভব নয়।
‘হলিডে মার্কেট’ সেই বিকল্প সমাধান হতে পারে। এতে হকাররা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রির সুযোগ পাবেন, শহরের নিয়মশৃঙ্খলা বজায় থাকবে, আর ফুটপাতও দখলমুক্ত থাকবে।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সিলেটের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, গৃহিণী, হস্তশিল্পী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত খুলে যাবে। একই সঙ্গে শহরের মানুষ পাবেন স্থানীয় পণ্য, হস্তশিল্প ও ঘরোয়া খাবার ক্রয়ের এক অনন্য সুযোগ।
শহর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্যোগ “অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি”-র দারুণ উদাহরণ হতে পারে—যেখানে ধনী-গরিব সবাই নগরের অর্থনৈতিক প্রবাহে যুক্ত থাকবে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “হলিডে মার্কেট ধারণাটি মানবিক ও বাস্তবসম্মত। প্রশাসনের অনুমোদন পেলে আমরা এটি বাস্তবায়নের বিষয়ে ইতিবাচকভাবে ভাবতে পারি।”
একজন নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন-
“মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নগর পরিকল্পনা একসাথে কাজ করলেই টেকসই নগর গড়ে ওঠে। সিলেটের জন্য হলিডে মার্কেট কেবল একটি বাজার নয়, এটি হতে পারে সমাজ-অর্থনীতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রতীক।”

সিলেট সিটি কর্পোরেশন, ট্রাফিক বিভাগ এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি ‘হলিডে মার্কেট কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। মার্কেট চলাকালে পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করলে এ উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব।
অন্যদিকে হলিডে মার্কেট ব্যবস্থাপনায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্য একটি নতুন রাজস্ব খাতও সৃষ্টি হতে পারে। মার্কেটে অংশগ্রহণকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে সামান্য চাঁদা বা ফি গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে একদিকে মার্কেট পরিচালনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার খরচ নির্বাহ করা সম্ভব হবে; অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনের জন্য এটি একটি স্থিতিশীল আয় উৎস হিসেবেও কাজ করবে।এই প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের জন্যও থাকবে স্বচ্ছতা ও বৈধতার নিশ্চয়তা, আর প্রশাসনের জন্য হবে একটি সংগঠিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ মার্কেট ব্যবস্থাপনা।

সিলেট নগরীতে প্রতি শুক্রবার নির্দিষ্ট সময়ে ‘হলিডে মার্কেট’ চালু হলে এটি একদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা দেবে, অন্যদিকে শহরের সৌন্দর্য, শৃঙ্খলা ও মানবিক ভাবমূর্তি বাড়াবে বহুগুণে।
সিটি কর্পোরেশন যদি সাহসী ও সংগঠিত পদক্ষেপ নেয়, তবে সিলেট হবে দেশের প্রথম শহর, যেখানে আধুনিক ও মানবিক নগরচিন্তার এমন প্রয়োগ বাস্তবে দেখা যাবে।

ডিএস/এমসি

Explore More Districts