এনামুল হক, ধর্মপাশা
যেখানে নেই কোনো হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রোগীর রোগ নির্ণয়েও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। সর্দি-কাশি, জ্বর, মাথা ব্যাথার চিকিৎসায় ভরসা স্থানীয় ফার্মেসি। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হাসপাতালে নিতে গিয়ে চিকিৎসার অভাবে যেখানে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটতো সেখানেই তিন বছর ধরে পাওয়া যেতো চিকিৎসা সেবা। প্রসূতির মায়েদের নিরাপদ প্রসবের ব্যবস্থাসহ সেবা মিলতো ছোটখাটো অসুধ বিসুখের। ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে একাই সে সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন হাসনা আক্তার নামের একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে প্রসূতি মা ও শিশুসহ অন্যান্য চিকিৎসা সেবা বন্ধ রয়েছে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। এদিকে লোকবল সংকটের কারণে মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আপাতত কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে স্থানীয়রা আবারও প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা সেবা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
যে কারণে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র
মধ্যনগর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সড়ক পথে পৌঁছাতে প্রায় ৪৫ মিনিট, চামরদানী ইউনিয়ন থেকে ট্রলারযোগে মধ্যনগর হয়ে ধর্মপাশা আসতে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা, বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়ন থেকে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘন্টা ও বংশীকুন্ডা উত্তর ইউনিয়ন থেকে প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগে। বর্ষাকালে দীর্ঘ সময় পার করে রোগী নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাতে পারলেও হেমন্তকালে ওই ইউনিয়নগুলো থেকে মধ্যনগর আসতেই যথাক্রমে ২-৩ ঘন্টা সময় লাগে। ফলে মধ্যনগর অঞ্চলের মানুষজন মূমুর্ষূ রোগী নিয়ে চলে যান নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তাই মধ্যনগর থানার চার ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় থেকে মধ্যনগর ও বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের দাতিয়াপাড়ায় পৃথকভাবে ১০ শয্যা করে দুটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ভবন, আবাসিক ভবন, গভীর নলকূপ স্থাপন, সংযোগ সড়ক ও ভবনের চারদিকে দেয়াল নির্মাণসহ উন্নয়ন কাজের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। সম্রাট এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজ পায়। দুটি সাস্থ্যকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি টাকার উপরে।
অসম্পন্ন নির্মাণ কাজে ত্রুটি
কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে কিছুটা সময় বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এখনও দুটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিছু কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। মধ্যনগর ও মা শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ভবনের সামনের সংযোগ সড়ক দেবে গেছে। ভবনের নিচে ও আশপাশে মাটি ভরাট হয়নি। ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে, সিড়ির পলেস্তারা ওঠে গেছে, বিদ্যুতের ওয়্যারিং ঠিকমতো করা হয়নি। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় কোনো কোনো দরজায় ফুটো দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ জানালার গ্লাস ভেঙে গেছে। ভবনের ভেতর কোথাও কোথাও বৈদ্যুতিক তার ঝুলে আছে। রয়েছে বৈদ্যুতিক ত্রুটি। সরবরাহ করা হয়নি জেনারেটর। পাম্পের পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে স্থানীয়ভাবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসিক ভবনেরও বেহাল দশা। অপরদিকে দাতিয়াপাড়া ফুলেন্নেছা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের কাজও পুরো শেষ হয়নি। মাটি ভরাট, সীমানা দেয়ালসহ ভবনগুলোতে রয়েছে নানান ত্রæটি।
সম্রাট এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার মোয়াজ্জেম হোসেনের ব্যবসায়ীক অংশীদার শাহাদাত হোসেন টিংকু বলেন, ‘শতভাগ কাজ শেষ করে বছর দুয়েক আগে সুনামগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালকের কাছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র দুটি হস্তান্তর করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্যকেন্দ্র দুটির অবশিষ্ট কাজ ঠিকাদার শিঘ্রই করে দিবে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী উজ্জ্বল মিয়া।
লোকবল সংকট
ধর্মপাশায় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে দুটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও সদর ক্লিনিকে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার ১৫টি পদ রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ১২টি পদ শূন্য। মধ্যনগরবাসীর মা ও শিশু স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে হাসনা আক্তারকে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ওই পদে পদায়ন করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন)। তখন থেকেই হাসনা আক্তার একাই মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে একাই সেবা দিয়েছেন। কিন্তু গত ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে ২৯ বছর বয়সে তার অকাল মৃত্যু হয়। তখন থেকেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চিকিৎসা সেবা বন্ধ রয়েছে। হাসনা আক্তার তিন বছরে আড়াই শতাধিক নারীর নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে দাতিয়াপাড়া (ফুলেন্নেছা) মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচ ইউনিট থেকে অস্থায়ীভাবে একজন নার্সিং এটেন্ড্যান্ট ও বেসরকারি প্রকল্প থেকে থেকে একজন মিডওয়াইফ (প্রসবসেবায় পারদর্শী) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও দুটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই একজন করে পিয়ন কাম চৌকিদার রয়েছে।
মধ্যনগর বাজারের বাসিন্দা মাকসুদা বেগম বলেন, ‘একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা দক্ষতার সাথে আমাদের মা ও শিশুসহ সকলের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করেছেন। এখন আমাদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো কেউ নেই। হাওরাঞ্চলের দুর্গম যোগাযোগের কারণে এমনিতেই স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় থাকি। এখন দুশ্চিন্তা আরো বাড়লো।’
দুটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেসব সেবা পাওয়া যাবে
স্বাস্থ্য কেন্দ্র দুটিতে দুইজন করে মেডিকেল, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকাসহ বেশি কিছু লোকবল নিয়োগের প্রস্তাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক। তিনি জানিয়েছেন, এসব লোকবল নিয়োগ হলে এখানে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের যাবতীয় চিকিৎসাসহ প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক প্রসব, অস্ত্রোপচার ও অন্যান্য সাধারণ রোগের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে এখানে।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান রনি বলেন, ‘আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে একজন মিডওয়াইফ (সেবাদানকারী) দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট উপ-পরিচালক আশ্বস্থ করেছেন।’
সুনামগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক নিরঞ্জন বন্ধু দাম বলেন, ‘আমি চার মাস আগে যোগদান করেছি। দুই বছর আগে স্বাস্থ্য কেন্দ্র দুটি হস্তান্তর করা হয়েছে। (ত্রুটির ব্যাপারে) এর বেশি কিছু বলতে পারবো না। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার মৃত্যুতে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ আছে। আমরা সেখানে (মধ্যনগর) লোক দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
