ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ফরিদপুরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি : বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা

ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ফরিদপুরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি : বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা

ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ফরিদপুরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি : বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা

স্টাফ রিপোর্টার : ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রতিদিনই অবনতির দিকে যাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যু। গত মঙ্গলবার সকাল ৮ টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩৯জন। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে বুধবার পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩১৮ জন। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের নয় তারিখ পর্যন্ত ফরিদপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা গত ২১ জুলাই। ওই দিন থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৮ দিনে ডেঙ্গুতে ৭ জন মারা গেছেন।

ফরিদপুর সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ফরিদপুরে ২০১৮ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৫৯ জন, ২০১৯ সালে ৮৭, ২০২০ সালে ২০৩, ২০২১ সালে ৩৮৭ এবং গত বছর ২০২২ সালে ১ হাজার ২২৯ জন। এতে দেখা যাচ্ছে গত পাঁচ বছর ধরে ফরিদপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ফরিদপুর সিভিল সার্জনের কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে প্রতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর আক্রান্তের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

চলতি বছর সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত সাত মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে কেউ আক্রান্ত হয়নি, ফেব্রæয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ জন, মার্চে ৭ জন, এপ্রিল ১২জন, মে মাসে ১৯ জন, জুন মাসে ৪৩ জন এবং ‘পিকপর্ব’ শুরুর প্রথম মাস জুলাইতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২০ জন। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১.৪৭ গুন, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ২.৩৩ গুন, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ১.৯১ গুন এবং ২০২১ এর তুলনায় ২০২২ সালে ৩.১৮ গুন। এতে দেখা যাচ্ছে মাঝে ২০২১ সালে ফরিদপুরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কিছুটা নি¤œগামি হলেও ২০১৮ সাল থেকে বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয় এবং গত ২০২১ এর তুলনায় ২০২২ সালে এ বৃদ্ধি ৩.১৮ গুন।

ফরিদপুরে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি

চলতি বছর জুনে ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪৩ জন। জুলাই মাসে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২০ জন। অর্থাৎ জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী সংখ্যা বেড়েছে ১৪.৪২ গুন। আগস্টে এ প্রবণতা যে আরও বাড়বে প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা তাই জানান দিয়ে যাচ্ছে। গত গত ১ আগস্ট থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ৯ দিনে ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৫০জন। অর্থাৎ গত জুলাই মাসে যতজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল (৬২০) আগস্টের প্রথম নয় দিনেই সে সংখ্যা অতিক্রম করে ৩৩০ জন রোগী বেশি হয়েছে।

১৯ দিনে মৃত্যু সাত জনের গত ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে চলতি বছর পর্যন্ত ফরিদপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে জুলাই মাসের ২১ তারিখে। জুলাই মাসের ২১ তারিখ থেকে গত ৮ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ দিনে মারা গেছেন সাত জন। ২১ জুলাই ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা যান জাহানার বেগম (৩৯) নামে এক গৃহবধূ। তিনি রাজবাড়ী সদর উপজেলার দ্বাদশী ইউনিয়নের বাসিন্দা। দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ২৭ জুলাই। ওই দিন মারা যান রুমা দাস (২৫) নামে এক অস্তঃসত্ত¡া গৃহবধূর। তিনি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পারুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

২৮ জুলাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সোহেল মিয়া (১৮) নামে এক তরুণ। তিনি মাগুরা সদর উপজেলার আমুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা লাখো মিয়ার ছেলে। আগস্টে প্রথম নয় দিনে এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে চারজনের। গত ৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার মারা যান জয়নাল আরোফিন (৬৫)। তিনি রাজবাড়ী সদরের বেড়াডাঙ্গা গ্রামের মৃত মিজানের ছেলে। ৫ আগস্ট মারা যান ফরিদা বেগম (৫৫)। তিনি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বনমালিদিয়া মহল্লার বাসিন্দা আবুল হোসেনের স্ত্রী। ৭ আগস্ট মারা যান ময়না বেগম (৪০)। তিনি ফরিদপুরের সালথার যদু নন্দীপুর গ্রামের মো. ফরহাদের স্ত্রী। ৮ আগস্ট মারা যান মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুরের শহীদুল্লাহ মিয়ার ছেলে মাহাবুব ভ’ঁইয়া (৩৫)।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যবস্থা

ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রোগী বাড়ার প্রেক্ষাপটে গত ২০ জুলাই ৩৭ শয্যার একটি ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করেন ওই হাসপাতালের কর্তপক্ষ। গতকাল বুধবার ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায় এ হাসহাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন ১৩৯ জন। নির্ধারিত ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ধারণ ক্ষমতা কম হওয়ায় পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ও পেইন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্ণার করে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তারপরও শয্যার সংকুলান না হওয়ায় ওয়ার্ডের মেঝেতে হাসপাতালের করিডোরে ও বারান্দায় ডেঙ্গু রোগীদের রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতর দ্রæত অবনতি ঘটলেও প্রশাসনিক উদ্যোগে সমন্বয়হীনতার ভাব লক্ষ করা গেছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হলেও গত জুলাই থেকে গতকাল ৯ আগস্ট পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে কোন সমন্বয় সভা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন ফরিদপুরের সিভিল সার্জন মো. ছিদ্দীকুর রহমান। সিভিল সার্জন ও পৌরসভার উদ্যোগে বিচ্ছিন্ন ভাবে মাইকিং হচ্ছে। সিভিল সার্জনের উদ্যোগে কয়েকটি উচ্চ বিদ্যালয়ে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। পৌরসভার উদ্যোগে মাঝে মাঝে মশক নিধনের জন্য ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, এ অবস্থায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দ্রæত একটি সমন্বয় সভা করে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট ভাবে দায়িত্ব দিয়ে মনিটরিংএর মাধ্যমে কাজ করানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড বাড়িয়ে ৩৭ শয্যা থেকে কমপক্ষে ৩০০ শয্যায় উন্নীত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন ওয়ার্ডের ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্য রোগীদের একসাথে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সঠিক হচ্ছে বলে মনে করছি না। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

সকলের ঐকান্তিক সচেতনতা ও আন্তরিকতা ছাড়া এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কষ্টকর। তিনি বলেন, সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। এর আগে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার জানিয়েছিলেন, ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতির দ্রæত অবনতি ঘটছে। আগামী ৯ আগস্ট ডেঙ্গু বিষয় নিয়ে জরুরী সমন্বয় সভা করা হবে। এতে সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকসহ সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যাক্তিদের আহŸবান করে তাদের পরামর্শ মত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ৯ আগস্ট দুপুর ১২টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এ সমন্বয় সভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারশবশত এ সভাটি অনুষ্ঠিত হয়নি।

Explore More Districts