বৈরি আবহাওয়াসহ নানা কারণে কমছে সুন্দরবনের মধু উৎপাদন

বৈরি আবহাওয়াসহ নানা কারণে কমছে সুন্দরবনের মধু উৎপাদন

দেশের মোট উৎপাদিত মধুর
অর্ধেক আসে সুন্দরবন থেকে

রফিউল ইসলাম টুটুল ঃ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাদ্যের মধ্যে অন্যতম পানীয় হচ্ছে মধু। এতে রয়েছে যেমন নানা রকমের ঔষুধী গুন তেমনি খেতেও সুস্বাদু। আর দেশের এ মধু উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে সুন্দরবন। এখানকার মধু স্বাদ, রং ও গন্ধে অতুলনীয়। এ কারনে সুন্দরবনের মধুর চাহিদাও রয়েছে অনেক। এখানে বিভিন্ন ফুলের মধুর মধ্যে খলিশা ও গরান ফুলের মধু অন্যতম। দেশের মোট উৎপাদিত মধুর ৫০ শতাংশ সুন্দরবন থেকে আহরণ করা হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারনে অনেকটাই কমছে সুন্দরবনের মধু উৎপাদন। বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মধুর উৎপাদন কমেছে।
বন বিভাগের সূত্র মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছিল চার হাজার ১০৬.১৫ কুইন্টাল ও মোম সংগ্রহ হয়েছিল এক হাজার ২৩১ কুইন্টাল। আবার ২০২১-২২ অর্থবছরে মধু দুই হাজার ৮২০ কুইন্টাল ও মোম ৮৫৫ কুইন্টাল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা’ দাঁড়ায় দু’হাজার ৪০০.৭৫ কুইন্টাল ও মোম এক হাজার ১২৫.১০ কুইন্টাল।
মধু উৎপাদনের এই হার কেন নি¤œমূখী জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, মূলত দু’টি কারনে সুন্দরবনের মধু উৎপাদন কমার প্রবনতা দেখা যায়। একটি প্রাকৃতিক কারণ অন্যটি মানবসৃষ্ট। যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়া মধু উৎপাদন কম হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অধ্যাপক নজরুল বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে মার্চের শেষ বা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বৃষ্টিপাত হয়। ঐ সময় গাছে প্রচুর ফুল ফোটে। ফুলের পরিপূর্ণতার জন্য ঐ সময়ের বৃষ্টি খুবই উপকারী। তবে বৃষ্টি না হলে ফুলগুলো সঠিকভাবে বিকশিত হতে না পেরে এতে নির্যাস কমে যায়। এসব ফুল থেকে মৌমাছি খুব কম পরিমাণই মধু সংগ্রহ করতে পারে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, সুন্দরবন এলাকায় ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বষ্টিপাতের পরিমান ছিল যথাক্রমে ০০, ১০৯, ৬৭, ০০, ০০, ৯৮ মিলিমিটার এবং এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল যথাক্রমে ৭৮, ৭৪, ৮, ১, ৪ ও ৫৩ মিলিমিটার। বনবিভাগের তথ্যেও দেখা যায় ঐ সময়ে মধু উৎপাদনের হারও নিম্মমূখী ছিল।
অধ্যাপক নজরুলের মতে স্বাভাবিক নিয়মে বৃষ্টিপাত না হওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এছাড়াও মৌয়ালদের অজ্ঞতা বা প্রশিক্ষিত না হওয়ার কারনেও মধু আহরণ কম হয়ে থাকে। দেখা গেছে, মৌয়ালরা প্রায় সময়ই মৌচাকের প্রায় পুরো অংশটুকুই কেটে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে সেই চাক তৈরি করতে মৌমাছিদের অনেক সময় লাগে। এছাড়া চাকের পুরো অংশে মধু থাকেনা। একটি অংশে মৌমাছির বাচ্চা ও ডিম থাকে। কিন্তু সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকায় অধিকাংশ সময় মৌয়ালরা ঐ ডিম ও বাচ্চা মেরে ফেলে। ফলে মৌমাছির বংশবিস্তার বাঁধাগ্রস্ত হয়। এছাড়াও এক কেজির একটি চাক তৈরি করতে একদল মৌমাছির যে সময় লাগে, ঐ একই সময়ে তারা ২০ কেজি মধু উৎপাদন করতে পারে। তাই মৌয়ালরা পুরো চাক না কেটে শুধু মধুযুক্ত অংশ কাটলে পুনরায় মৌমাছিদের ঐ চাকটি তৈরি করতে কম সময় লাগে। এজন্য মৌয়ালদের প্রশিক্ষণ ও বনে ঢোকার পাশ দেয়ার সময় পর্যবেক্ষণে রাখলে মধুর উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশী মধু উৎপাদন সাতক্ষীরা রেঞ্জে। এ অঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ মৌয়াল বা মাওয়ালী পেশার সাথে যুক্ত। তবে গোটা সুন্দরবনে পাঁচ হাজারের বেশী মৌয়াল মধু সংগ্রহের কাজ করে থাকে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের বাসিন্দা দিদার বকস্(৬৮) প্রায় ৩০ বছর ধরে মধু কেটে জীবিকা নির্বাহ করে। তিনি বলেন চৈত্র বৈশাখ মাসের বৃষ্টি মধু উৎপাদনের খুবই সাহায্য করে। এ সময় ফুল যত ভাল ও বেশী হবে ঐ মৌসুমে মধু তত বেশী হবে। কিন্তু এখন ভরা মৌসুমেও খরা থাকায় ফুল শুকিয়ে যায় এবং ফুলের রসও কম হয়। তিনি বলেন, যে বছর ঠিকমত বৃষ্টি হয়না সে বছর মধু কম হবেই। একই ইউনিয়নের রবিউল সানা(৫৩)। তিনিও প্রায় ৩০ বছর মধু কাটার সাথে জড়িত। মধু উৎপাদনে বৃষ্টির উপকারিতার কথা তিনিও উল্লেখ করে বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অনেকে এখন এ কাজ থেকে সরে আসছেন। তিনি বলেন, একটি দলে আট থেকে ১০ জন থাকে। বনের ভেতর ঢুকে সবাইকে আলাদা হয়ে যেতে হয় এবং একজন আরেকজন থেকে ৩০ থেকে ৫০ ফুট দূরে থেকে মৌচাকের সন্ধান করা হয়। তখন চাকের দেখা পেলে বিশেষ ডাকের মাধ্যমে সবাই এক জায়গা হয়ে চাক কেটে মধু নামানো হয়। এ সময় তাদের হাতে একটি দা ও একটিমাত্র লাঠি থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাফেরার সময় অনেক সময় বাঘের আক্রমনের শিকার হতে হয়। এছাড়াও বিষাক্ত সাপসহ অন্যান্য প্রানীর আক্রমনেরও ঝুঁকি থাকে। এ কারনে অনেকেই এখন বনে যেতে চায় না বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও কথা হয় বুড়িগোয়ালীনি, গাবুরা ইউনিয়নের আবুল কালাম, সহিদুল গাইন, ইমদাদুল হক, সোহাগ হোসেন, তমাল হোসেন, ছবেদ আলী ও আতিয়ার রহমানের সাথে। তারা সবাই কমপক্ষে ২৫ বছর ধরে নিয়োজিত আছেন মাওয়ালী পেশার সাথে। তারা বলেন, উচ্চ হারে দাদন ব্যবসা ও অভয়ারণ্য বৃদ্ধির কারনেও মধু উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। মধু সংগ্রহের মৌসুম বলা হয় এপ্রিল থেকে মে এই দুইমাস। এ সময় মৌয়ালদের অন্য কোন কাজ থাকে না। তাই উচ্চ হারে দাদন নিয়ে মধুু কাটতে যান মৌয়ালদের একটি বড় অংশ। কিন্তু মধু কেটে ফিরে এসে বাজার মূল্যের কম দামে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে মধু বিক্রি করতে হয়। বর্তমান পাইকারি বাজার মূল্য এক হাজার থেকে ১১শ’ টাকা কেজি হলেও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা কমে বিক্রি করতে হয়। এতে খুব বেশী লাভ হয়না তাদের। এছাড়াও বনবিভাগ অভয়ারণ্য এলাকা বৃদ্ধি করার কারনেও মধু আহরন কম হচ্ছে বলে জানান তারা।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের ডিএফও ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন জানান, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকা ছিল ২৩%। তবে ২০২০ সাল থেকে তা বাড়িয়ে ৫২% করা হয়েছে। কিন্তু শুধু অভয়ারণ্যের কারনেই মধু উৎপাদন কম হচ্ছে বিষয়টা তা নয়। বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির কারনে অনেকেই বসবাসের এলাকায় বক্স পদ্ধতিতে মধু উৎপাদন করছে। এটিও একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
মধু ব্যবসায়ী শরিফুল হিরন বলেন, মধুপ্রমীদের কাছে সুন্দরবনের মধুর চাহিদা সবচেয়ে বেশী। একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন হয় বলে এই মধুর দামও পাওয়া যায় বেশী। খুচরা পর্যায়ে ১৫শ’ থেকে দু’হাজার টাকা বিক্রি হয় সুন্দরবনের মধু। আরেক ব্যবসায়ী মোঃ সালাহউদ্দিন বলেন, প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও মানবসৃষ্ট কারণগুলো দূর করতে পারলে বর্তমানে মধু উৎপাদনের যে নিম্মমুখী হার তা রোধ করা সম্ভব।

Explore More Districts