বেগম রোকেয়ার জন্মস্থানের ধ্বংসাবশেষ হারানোর পথে

স্টাফ রিপোর্টার:
কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে রোকেয়ার সাখাওয়াতের জন্মস্থানের ধ্বংসাবশেষ।বাংলার ইতিহাসের অবিস্মরণীয় একটি নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত । উপমহাদেশে মুসলিম নারীর যে অগ্রগতি, তার পেছনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্মময় জীবন অন্তহীন প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। তার দেখানো পথে হেঁটে নারীরা আজ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও পথপ্রদর্শকের জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে নির্মিত স্মৃতিকেন্দ্রটি একটি মাত্র ভবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে সংরক্ষণের অভাবে রোকেয়ার জন্মস্থানের ধ্বংসাবশেষ ক্রমেই মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
একটি জানালা ও কয়েকটি পিলার এখন পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে রোকেয়া কেন্দ্রের জমি নিয়েও চলছে বিরোধ। সমাধানের জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে রোকেয়া দিবস উদযাপন করা হয়। দিবসটি ঘিরে ধোঁয়া মোছা এবং রং করা হয়। এরপর রোকেয়া অনুরাগীদের দাবির বিষয় যেন ভুলেই যান সংশ্লিষ্টরা। ফলে আলোর মুখ দেখছে না রোকেয়াকে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার মরদেহ ভারত থেকে দেশে আনার দাবি দীর্ঘদিনের। সে প্রক্রিয়াও রয়েছে ফাইলবন্দি। স্থানীয়রাসহ রোকেয়া প্রেমীদের প্রত্যাশা, রোকেয়ার মরদেহ ভারত থেকে নিয়ে এসে পায়রাবন্দের মাটিতে সমাহিত করা হোক।
স্মৃতিকেন্দ্রটি ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ রুমের জানালার কাঁচ ভাঙা। সংগ্রহশালার ধূলিমলিন কাচের আলমারিগুলোতে কখনোই কোনো স্মারক রাখা হয়নি। শ্যাওলা পড়েছে অনেক রুমের দেয়ালে । রুমের ভেতরের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে ।
ঘুরতে আসা দর্শনার্থী শারমিন আক্তার বলেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার স্মৃতিকেন্দ্রে রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য ছাড়া আর দেখার কিছুই নেই। এখানকার লাইব্রেরিতে রোকেয়া সম্পর্কিত পর্যাপ্ত বই নেই। এমনকি মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে নিয়ে জানার তেমন কিছুই নেই এখানে।
মিঠাপুকুর প্রেসক্লাবের সভাপতি শেখ সাদী সরকার বলেন, পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়াকে জানার যে আগ্রহ, প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ ছুটে যায়, সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি আরও সৃজনশীল করে গড়ে তোলা প্রয়োজন । সেই সঙ্গে জন্মভিটার ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করা উচিত। এছাড়াও রোকেয়ার দেহবশেষ ভারত থেকে নিয়ে আসা, এবং বেদখলে থাকা রোকেয়ার পৈত্রিক জমি উদ্ধার করা সময়ের দাবি।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন ৩ একর ১৫ শতক জমির উপর রোকেয়ার বসতভিটায় রংপুরের পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া গবেষণা ও স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০১ সালের ১ জুলাই তিনি স্মৃতিকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন। প্রথম দিকে স্মৃতিকেন্দ্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর দায়িত্ব নেয় বাংলা একাডেমি। স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিলো বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতি চর্চা এবং স্থানীয় তরুণ তরুণীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বেগম রোকেয়ার স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। ওই বছরের ১৭ মার্চ অলিখিতভাবে স্মৃতিকেন্দ্রটি বিকেএমইর শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। শুরু হয় সেখানে পোশাকশ্রমিক তৈরির প্রশিক্ষণ। এর উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন-উ-আহমেদ।
স্মৃতিকেন্দ্রটির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করে সেখানে পোশাক শ্রমিক তৈরির প্রশিক্ষণ বন্ধ এবং বিকেএমইকে উচ্ছেদ করার জন্য পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বেগম রোকেয়ার স্মৃতিকেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং শ্রমিক তৈরির কারখানা বন্ধের আদেশ দেওয়ায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ২০১২ সালের ১ মে বিকেএমইএকে উচ্ছেদ করে সেখান থেকে।
পায়রাবন্দ রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, ৯ ডিসেম্বর এলে ঘষা-মাজার কাজ শুরু হয়। নানা আয়োজন হয় বেগম রোকেয়াকে নিয়ে। কিন্তু ১১ ডিসেম্বরের পর আবারও রোকেয়া ১ বছরের জন্য হারিয়ে যায় এখান থেকে। রোকেয়া যেন হারিয়ে না যায়, এজন্য বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু রাখা প্রয়োজন। তাহলে রোকেয়া সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে এবং স্মৃতিকেন্দ্রে ঘুরতে আসলে মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারবে।