বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও চাঁদপুরের শিক্ষক আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও চাঁদপুরের শিক্ষক আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপি পালন করা হয়। এবার ২০২৫ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: ২০২৫‘স্থায়ী শান্তির জন্য শেখা’,যা বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজতে শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকার ওপর আলোকপাত করে। এ স্লোগান দিয়ে বিশ্বব্যাপি এবার দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এ রকম একটি প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়।

১৯৯৫ সাল থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে- বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এ দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করার জন্য, জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা এবং এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল প্রতি বছর একটি প্রচারণা চালায় যাতে বিশ্বকে শিক্ষকদের সম্পর্কে আরও ভালভাবে বোঝাতে পারে যে, তারা শিক্ষার্থী এবং সমাজকে বিকশিত করতে কতটা ভূমিকা পালন করে। তাই তারা তাদের প্রচারণার জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সাথে কাজ করে যেমন- গণমাধ্যম সংস্থার সাহায্যে তারা তাদের কাজ সম্পাদন করে। প্রচারণাটি প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন থিমে আলোকপাত করে থাকে।

২৫ সেপ্টেম্বর দিবসটি উদযাপনে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের নির্দেশনা দিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে অনুরোধ জানিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। ওই নির্দেশনার আলোকে দিবসটি উদযাপনে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্কুল-কলেজগুলোর প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষদের বলেছে অধিদপ্তর।

শিক্ষকতা হচ্ছে মহান ও একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা। এখনো সব পেশার মানুষ শিক্ষকদেরকেই বেশি ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। পৃথিবীতে যতগুলো পেশা রয়েছে- তার মধ্যে শিক্ষকতাকে মর্যাদার চোখে দেখা হয়। পৃথিবীতে মা বাবার পরের স্থান হচ্ছে শিক্ষকের। সমাজ ও দক্ষ মানবসম্পদ বির্নিমাণে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার কারিগর।

শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের মাঝে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সৃষ্টি করে। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী সুন্দর মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে এবং সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়- শ্রদ্ধাশীল হয়। শিক্ষকের এসব কৃতিত্বের স্বীকারোক্তির জন্য তাদের স্মরণ করতে ও কল্যাণ কামনার জন্য শিক্ষকের যে গুরুত্ব সেটা স্বীকার করার জন্য প্রতিবছর তাদের সম্মানার্থে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের লালনপালন এবং শিক্ষাগত অগ্রগতি চালনা করে ভবিষ্যত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য, তাদের কণ্ঠস্বর শোনা এবং তাদের পেশাকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে মূল্যবান হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষকদের যে পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হয়- তা’মোকাবেলা করার এবং শিক্ষায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার কাজই শিক্ষকের । “শিক্ষকের কণ্ঠের মূল্যায়ন: শিক্ষার জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি বা অঙ্গীকার বলা যেতে পারে”। ইউনেস্কো সদর দফতরে আয়োজিত এ বৈশ্বিক ইভেন্টটি শিক্ষাগত নীতিতে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি একীভূত করার এবং তাঁদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার গুরুত্বের ওপর জোর দেবে।

এ থিম টিচিং পেশার উপর জাতিসংঘের মহাসচিবের উচ্চ-স্তরের প্যানেল দ্বারা হাইলাইট করা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলির প্রতি সাড়া দেয়া এবং শিক্ষকদের উপর আমাদের সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রতিবেদন- যার মধ্যে ক্রমবর্ধমান শিক্ষকের ঘাটতি এবং ক্রমহ্রাসমান কর্মপরিস্থিতির মূল নতুন তথ্য উপস্থাপন করা। দিবসটি ইউনেস্কো, আইএলও, ইউনিসেফ এবং এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের উচ্চ-পর্যায়ের বার্তাসহ একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করবে।

এটি শিক্ষায় একটি নতুন সামাজিক চুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষকদের কণ্ঠস্বর প্রদর্শন করে, নীতি ও অনুশীলনের উন্নতির বিষয়ে তাদের অন্তর্দৃষ্টি ভাগ করে নেয়ার একটি অংশের উপর একটি মূল বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করবে।

শিক্ষক উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য ইউনেস্কো-‘ হামদান পুরস্কার’ প্রদান করবে বলে জানা যায়। ১৯৪৬ সালে ইউনেস্কো শিক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতা,অধিকার এবং আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক সনদ নামক একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের যৌতিকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্ত : সরকার সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত বিশেষ সুপারিশ মালা গ্রহণ করা হয়।

১৯৯৩ সালে বিশ্বের ১৬৭ টি দেশের ২১০ টি জাতীয় সংগঠনের ৩ কোটি ২০ লাখ সদস্যদের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠন “ এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল” গঠিত হয় এ আন্তর্জাতিক সংগঠন । জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো কর্তৃক প্রণীত দলিলটি যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করার অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ ও আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর মহা-পরিচালক ড.ফ্রেডারিক এম মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে ৫ অক্টোবর “ বিশ্ব শিক্ষক দিবস” পালনের শুভ সূচনা করা হয়।

ফলে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব শিক্ষক দিবস দিনটি সূচিত হয়। এটি সারা দেশ-বিদেশে শিক্ষক পেশাজীবীদের জন্য সেরা সম্মান। পরবর্তী প্রজন্মও যাতে কার্যকরি ও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে এ দিনটি পালন করে সেটাও উদ্দেশ্য। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল মনে করে,জাতীয় স্তরে সমগ্র বিশ্বেই একটি বিশেষ দিনকে স্বীকৃতি দেয়া জরুরি যেটি সমাজ-সংস্কার-শিক্ষায় শিক্ষকদের উপযুক্ত মান্যতা দান করার যোগ্য দিন। এর পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

আমাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ,আমাদের দায়বদ্ধতা বিশ্বাস,অন্যকে মান্যতা দেয়া,গুরুজনকে সম্মান জানানো, নিজেদের পারিবারিক রীতিকে মর্যাদা দেয়া-এ সমস্ত কিছুই শিখি বাড়ির গুরুজন ও অভিভাবকদের থেকেই। আদর্শ ও চরিত্রগঠন সব কিছুর প্রাপ্তি তাঁদের থেকেই। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে সর্বকাল থেকেই স্বীকৃত।

শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা স¤পর্কিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর থেকে বিশ্বের ১শ টি দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। বলতে দ্বিধা নেই-সরকারে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে আজ যাঁরা শিক্ষানীতি তৈরি করছেন , শিক্ষা অধিদপ্তর চালাচ্ছেন, স্যালেবাস বা কারিকুলাম তৈরি করছেন,পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনছেন, গাদা গাদা বই লিখছেন কিন্তু শিক্ষকদের কথা নেই,অবসর ও কল্যাণে যাঁরা কাজ করছেন-তারা সবাই কোনো এক সময়ে কোনো এক প্রাথমিক,স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।

শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থী ও সমাজের নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যাতে সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে-সে জন্য র‌্যালি-সভা-সেমিনার থেকে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্মানবোধ ও মর্যাদা যেন বৃদ্ধি পায়। নির্দেশনায় বলা হয়- শিক্ষার্থী,অভিভাবক ও সাবেক-বর্তমান শিক্ষক নিয়ে র‌্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনার করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজ উদ্যোগে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীসহ সবার শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান বৃদ্ধির জন্য সচেতনতা তৈরিতে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে র‌্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

আমার শিক্ষকতার ৩৫ বছরের জীবনে ডাক্তার, বিচারক, প্রফেসর, মাধ্যমিক শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষক, ব্যাংকার, প্রবাসী, সেনাবাহিনীর সদস্য,পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষিকা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও নানা পেশায় নিয়োজিত রয়েছে শত সাবেক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আজকের এ দিনে তাদের কথা মনে ভেসে আসে ও আত্মতৃপ্তিতে মন ভরে উঠে। জাগ্রত হয়-তাদের চেহেরা মনের মণিকোঠায়। ইচ্ছে হয় আবার ফিরে যাই-সেই পেশায় যে টুকু আদর্শ শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম-তা’ পুষিয়ে দিতে। হয়তো বয়স ও সময়ের কারণে এটা আর কখনোইা সম্ভব হবে না। কেননা -বয়স মানুষের জীবনে একটি বড় ফ্যাক্টর।

স্বাধীনতার পর থেকেই বেসরকারি স্কুল, কলেজ ,কারিগরি ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের জীবন বাঁচানোর জন্যে মাঠে নামতে হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮০- ২০২৩ পর্যন্ত ৪৩ বছরে এসে দাঁিড়য়েছে-শিক্ষক সমাজের দাবি আদায়ের আন্দোলন। বিগত বছরগুলোতে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, কারিগরি ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলন তেমন অগ্রগতি হয় নি। তবে কিছু নিয়ম কানুন সংশোধন করা হয়।

১৯৮৭ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ‘ জামিয়াতুল মোদাচ্ছেরীনের আহবানে বিজয়স্মরণীতে এসে বক্তব্য দেন এবং শিক্ষকদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে মাসে ১শ টাকা বাড়ি ভাড়া,১শ টাকা মেডিক্যাল ভাতা ও একটি ইনক্রিমেন্ট দিয়ে বলেছিলেন,‘ আমি এ দিয়ে শুরু করলাম; ভবিষ্যতে এটা বাড়তে থাকবে। ১শ টাকার বাড়িভাড়া ভাতা শিক্ষকগণ তা’ফিরিয়ে নিতে সরকারকে অনুরোধ করেছেন এবং ‘অসম্মানজনক বাড়ি ভাড়া ভাতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জেলায় জেলায় পলিথিন ও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে শিক্ষকগণ ঘর বানিয়ে দেখিয়েছেন।

শিক্ষকগণ ঈদের দিন বাড়ি বাড়ি কালো পতাকা উড়িয়ে আজকের উৎসব ভাতা আদায় করেন। যদিও মূল বেতনের ২৫% ভাগ শিক্ষক ও ৫০% কর্মচারীরা পাচ্ছেন। পৃথিবীর কোনো দেশে উৎসব ভাতা ভগ্নাংশে প্রদানের রেওয়াজ আছে বলে জানা নেই। সাবেক সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ পর পর দু’ বার বাড়িয়ে বর্তমানে বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা ও মেডিকেল ভাতা ৫শ’ টাকায় উন্নীত করেন যা শিক্ষক-কর্মচারীগণ পাচ্ছেন। এদিকে দেশের সকল শিক্ষক কর্মচারী কাছ থেকে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা ফান্ডে জমা দানের লক্ষ্যে প্রত্যেক শিক্ষক কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৬% হারে কেটে রাখার রেওয়াজ চালু ছিল।

১৯৯০ সাল থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবসর সুবিধা শুরু হয় ২০০২ সালে এবং কল্যাণ চালূ হয় ২০০৫ সালে। বিশ্বব্যাপি ১শ টি দেশের সাথে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে যথাযথ মর্যাদা,তাৎপর্য ও গুরুত্বসহকারে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দিবসটি পালন করে আসছে।

চাঁদপুরে বেসরকারি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ে ড.আলমগীরসহ বেশ ক’জন শিক্ষকর নেতৃবৃন্দের অবদান ছিল অতুলনীয়। কখনো আবেগজড়িত,কখনো বা জ্বালাময়ী বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে দাবি আদায়ের রাজপথের আন্দোলনে নিয়ে আসার মত দক্ষতা র কঅধ্যক্ষ ড.আলমগীবিরসহ এ সব নেতৃবৃন্দের ছিল । চাঁদপুরের সকল বেসরকারি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ের শীর্ষ শিক্ষক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

১৯৯৪ সালের সেরা শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্বে তাঁর সাথে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ছিলেন- বাকশিস সভাপতি অধ্যক্ষ ড.আলমগীর কবির পাটওয়ারী , সম্পাদক অধ্যক্ষ সাফায়াৎ আহমেদ ভূঁইয়া, কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক মতলবের অধ্যক্ষ রুহুল আমিন,কেন্দ্রিয় সমাজ কল্যাণ সম্পাদক সদরের অধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ,কেন্দ্রিয় শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মতলবের মো.মোশারেফ হোসেন , কচুয়ার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, মতলবের মরহুম অধ্যক্ষ ছালামত উল্লাহ, মরহুম অধ্যাপক সফিউল আযম শাহাজাহান ও হাজীগঞ্জের অধ্যক্ষ আজহারুল কবীর ও অধ্যক্ষ সোয়েব আহমেদ। মাধ্যমিক পর্যায়ের জেলা সদরের মরহুম আলতাফ হোসেন চৌধুরী, প্রধানশিক্ষক মরহুম সাখাওয়াত হোসেন, প্রধানশিক্ষক মরহুম আলী মোহাম্মদ, প্রধানশিক্ষক মরহুম নুর হোসেন, প্রধানশিক্ষক আব্বাস উদ্দিন, শাহরাস্তির মরহুম ছিদ্দিকুর রহমান, মতলবের শহিদুল্লাহ প্রধান, প্রধানশিক্ষক সূর্যকুমার নাথ, ফরিদগঞ্জের মরহুম সিরাজুল ইসলাম, সদরের অধ্যাপক হাসান আলী, অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ,অধ্যাপক আলাউদ্দিন, অধ্যাপক খোরশেদ আলম, মো.বিলাল হোসেন, ফরিদগঞ্জের মরহুম মাও.সালাউদ্দিন,মরহুমা কানিজ বতুল চৌধুরী প্রধানশিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন পাটওয়ারী, প্রধানশিক্ষক পঙ্কজ বিহারী, অরুণ কমুার মজুমদার, প্রিয়তোষ কর্মকার, প্রধানশিক্ষক মোমেনা খাতুন, প্রধানশিক্ষক ছায়া পোদ্দার , মতলবের প্রধান শিক্ষক বোরহান উদ্দিন ও হাইমচরের আবদুল মতিন প্রমুখ।

শিক্ষকদের চাকুরি জাতীয়করণ করার সময় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকেও পর্যায়ক্রমে সরকারি করার কথা থাকলেও এর পরবর্তী সরকারগুলো নানাবিধকারণে কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের লক্ষ্যে তারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফলে ওই সরকারগুলোর আমলে শিক্ষকরা ধর্মঘট,হরতাল, কর্মবিরতি, সমাবেশ, মহাসমাবেশ,বিক্ষোভ মিছিল,মানববন্ধন কর্মসূচি স্মারকলিপি পেশ,আলোচনা,পর্যালোচনা, মিটিং,মিছিল,কালো ব্যাচ ধারণ,কালো পতাকা উড্ডয়ন, এমপি-মন্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ ও ১শ’ টাকায় ঘর বানিয়ে রাত্রি যাপন ইত্যাদি কর্মসূচিগুলো দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করতে বাকশিসসহ চাঁদপুর জেলার স্কুল,মাদ্রাসা ও কারিগরিদেরকে এক প্লাটফরম থেকে নেতৃত্ব দিতেন।

ঢাকার প্রতিনিধি সভায় অত্যন্ত গঠনমূলক বক্তৃতা দিয়ে বা দিকনির্দেশনায় আন্দোলন বেগবান করেন। শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন অপরিহার্য। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি দু’টি শব্দ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবধানে বেসরকারি স্কুল ও কলেজ শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার । একই যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি,একই বিভাগে একই সিলেবাসে ও পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যক্রমে পাঠদান,এক ইনিয়ম কানুনে একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং একই সমাজে বসবাস করেও বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন নানাভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এ বিষয়গুলোর ওপর তিনি তাঁর বক্তৃতায় প্রাঞ্জলভাষায় উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে আরো দায়িত্ববান হতে পরামর্শ দিতেন ।

শিক্ষকদের প্রাপ্তিতে রয়েছে-পৌনে ৫ লাখ এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি ‘শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করা।’ শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ না হলে বৈষম্য থেকেই যাবে। দেশের সকল শিক্ষক সংগঠনগুলো এক হয়ে‘ শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যদূর করুন’সর্বশেষ শিক্ষক আন্দোলনকে বেগবান করতেও ঢাকার প্রেসক্লাবে চাঁদপুরের শিক্ষকদের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যক্ষ ড.আলমগীর কবির পাটওয়ারী। তিনি জানতেন এর সুফলভোগী তিনি হবেন না। তবুও বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্তি আদায়ে তিনি যে ত্যাগ শিকার করেছেন তা চাঁদপুরের শিক্ষক সমাজের কাছে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।

সুতরাং শিক্ষক আন্দোলনে চাঁদপুরের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় জানা যায়-দেশের প্রতিটি শিক্ষক আন্দোলনে যাঁরা ভূমিকা পালন করেছেন- তাঁদের প্রতি আজকের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে গভীর শ্রদ্ধা,অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞত্ াজানাই। যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন-তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। যাঁরা আজোও নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে অবসর জীবনে ্আছেন-তাঁদের সুস্বাস্থ্য,সুন্দর জীবন ও দীর্ঘায়ূ কামনা করছি। আর ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি মনে করছি। কেননা -আপনাদের এ অবদানের ঋণ কোনোদিনই শোধ হবার নয়। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘‘ উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই! নি:শেষে প্রাণ যে করিবে দান- ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই!”

চাঁদপুরের বেসরকারি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ের কঠিন আন্দোলন-সংগ্রামে বাকশিসসহ কেন্দ্রিয় ৩৭ টি শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী ‘ জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টে’র ব্যানারে শিক্ষকদের রুটি-রুজি ও আত্মমর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে সরাসরি এ নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। যাঁরা সংগঠনের জন্যে সময়,অর্থ, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন, উপদেশ দিয়ে এর গতি সঞ্চার করে আজ পর্যন্ত রেখেছেন তিনিও তাদের তাঁরাই ছিলেন প্রথম কাতারের শিক্ষকনেতৃবৃন্দ।

চাঁদপুরে স্বাধীনতাত্তোর স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্তি আদায়ে যাঁদের ভূমিকায় আজ শতভাগ বেতনভাতা, বাড়ি ভাড়া ভাতা, আংশিক হলেও উৎসব ভাতা, মেডিক্যাল ভাতা, কল্যাণ তহবিল গঠন ও অবসরসুবিধা,অষ্টম জাতীয় স্কেলভ’ক্ত হতে পেরেছে ১৯৯৪ সাল থেকে এসব আন্দোলনে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি চাঁদপুর জেলার সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের রয়েছে অবিচল আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ।

এদিকে সরকারিভাবে- বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর সারা দেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হবে। ইউনেস্কো ঘোষিত প্রতিপাদ্য অনুযায়ী প্রতিবছর দিবসটি উদযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে নীতিমালায়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যোগে এ দিবসটি উদযাপন করতে হবে। প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ১২ জন গুণী শিক্ষক দেয়া হয় সম্মাননা।

প্রতিবছর ৫ অক্টোবর ইউনেস্কো ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী সারা বিশ্বে শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হয়। ওই দিন বাংলাদেশেও জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা ও অবদান সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং গুণী শিক্ষককে সম্মাননা দেয়ার জন্য সব শিক্ষককে সম্মানিত করা হবে। ইতোমধ্যে দিবসটি উদযাপনে গুণী শিক্ষক সম্মাননা কমিটি, উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক দিবস উদযাপন কমিটি, জেলা পর্যায়ে শিক্ষক দিবস উদযাপন কমিটি,জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি,বাজেট কমিটি, প্রচার কমিটি,গুণী শিক্ষক বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে।

২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশে সরকারিভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যালি ও আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। দেয়া হবে গুণী শিক্ষক সম্মাননা।

লেখক পরিচিতি : আবদুল গনি, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক, চাঁদপুর টাইমস, চাঁদপুর। ২ অক্টোবর ২০২৫। ফোন : ০১৭১৮-২১১ ০৪৪ ।

Explore More Districts