বিলুপ্তির পথে বামনার খেজুরের রস ও গুড়

বিলুপ্তির পথে বামনার খেজুরের রস ও গুড়

২৮ November ২০২৫ Friday ১:০০:৫৬ PM

Print this E-mail this


বামনা ((বরগুনা) প্রতিনিধি:

বিলুপ্তির পথে বামনার খেজুরের রস ও গুড়

একসময় শীতকাল এলেই বাংলাদেশের উপকূলীয় বরগুনার বামনা উপজেলার গ্রামগঞ্জে যে উৎসবের আমেজ বইত, তার প্রধান আকর্ষণ ছিল সুস্বাদু খেজুরের রস ও গুড়। হেমন্তের মাঝামাঝি থেকে শীতের ভরা মৌসুম পর্যন্ত পুরো জনপদে চলত নবান্নের উৎসব। 

কিন্তু কালের বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট তিন কারণে সেই চিরচেনা দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। উপজেলার গ্রামে-গ্রামে শীতের সকালে মিষ্টি রোদের তাপ নিতে নিতে মাটির ভাঁড়ে খেজুরের সুস্বাদু রস পান করার স্মৃতি আজও অমলিন। শুধু পানীয় হিসাবে নয়, এই রস দিয়ে তৈরি হতো নানান ধরনের পিঠা, পায়েস, ক্ষীর এবং লোভনীয় পাটালি ও নালি গুড়। এটি ছিল বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নবান্নের সেরা উপহার ও আবহমান বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। খেজুর গুড় ছাড়া এই অঞ্চলের শীতকালীন উৎসব ভাবাই যেত না। খেজুরের রস ছিল গ্রামীণ জীবনের শীতের উৎসবের মূল সূচনা।

এখন চোখে পড়ে না রস আহরণে গাছিদের সেই ব্যস্ততা। কোমরে দড়ির সঙ্গে ঝুড়ি বেঁধে ধারালো দা দিয়ে গাছ চাঁচাছোলা ও নলি বসানোর কাজ। এখন শুধু ক্যালেন্ডার ও ছবিতেই সেই দৃশ্য দেখা যায়। সাতসকালে খেজুরের রস নিয়ে গাছিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁকডাক দিতেন, সেই দৃশ্যও এখন বিরল। ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস ও গুড় দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় হতাশ এ অঞ্চলের গাছিরা। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে অচিরেই এই ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে। তবে অল্পকিছু নিবেদিতপ্রাণ গাছি এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

বামনা উপজেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সিডর, আইলার আঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খেজুর গাছ কমে গেছে। গত ৯-১০ বছর ধরে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। একসময় শীতকালে এই অঞ্চলের সর্বত্র শীত উদ্যাপনের আয়োজন শুরু হয়ে যেত এবং অতিথিদের রসের তৈরি পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করার প্রচলন ছিল। এখন রস না পাওয়ায় নবান্নের সেই আনন্দ থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। 

বামনা উপজেলার রামনা ইউনিয়নের বলইবুনিয়া গ্রামের গাছি মো. ফিরোজ মিয়া জানান, আগে তাদের দারুণ কদর ছিল। মৌসুম শুরুর আগে থেকেই কথাবার্তা পাকা হতো কার কটি খেজুর গাছ কাটতে হবে। কিন্তু এখন আর আগের মতো গাছও নেই, আর গ্রামের লোকরাও তেমন খেজুর রস সংগ্রহ করতে চান না। তারা অল্পকিছু গাছ কেটে নিজেদের চাহিদা মেটান।

উপজেলার বুকাবুনিয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরা গ্রামের গাছি আব্দুল খালেক দফাদার এখনো রস সংগ্রহ করছেন। প্রতিদিন ভোরে গাছিদের কাছে খেজুরের রস খাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের ভিড় দেখা যায়। রস সংগ্রহের জন্য তিনি বাদুড়ের সংস্পর্শ এড়াতে বাঁশের বেড়া দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। গাছি খালেক দফাদার বলেন, শীত মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত রসের সন্ধান পাচ্ছি না। গ্রামে দিনদিন কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। গাছ কম থাকায় এখন শুধু রস বিক্রি করা হয়। প্রতি গ্লাস রসের দাম ২০ টাকা এবং প্রতি লিটার ৮০ টাকা। তিনি বলেন, অনেক গাছ কেটে ফেলেছে। এজন্য রসের দাম বেশি। 

বামনা উপজেলাজুড়ে খেজুর গাছ কমে যাওয়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ দায়ী। এর মধ্যে রয়েছে-ইটভাটার জ্বালানি হিসাবে খেজুর গাছের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গাছিদের অভাব ও পেশার অনিশ্চয়তা।

পরিবেশ রক্ষা এবং রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগানোর দাবি উঠেছে। বামনার বাসিন্দারা বলছেন, এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও জরুরি। এখনই যদি খেজুর গাছ লাগানো ও রক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু স্মৃতিতেই খুঁজে পাবে এই ঐতিহ্যকে।

সম্পাদনা: আমাদের বরিশাল ডেস্ক


শেয়ার করতে ক্লিক করুন:

Explore More Districts