বিয়ানীবাজারে একের পর এক আত্মহনন: অসংখ্য নিঃশব্দ মৃত্যু

বিয়ানীবাজারে একের পর এক আত্মহনন: অসংখ্য নিঃশব্দ মৃত্যু

বিয়ানীবাজারে একের পর এক আত্মহনন: অসংখ্য নিঃশব্দ মৃত্যু

সিলেটের বিয়ানীবাজারে যেন একের পর এক মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। একের পর এক আত্মহননের ঘটনায় দিশেহারা পরিবার, হতবাক স্থানীয় সমাজ। গত কয়েক বছরে এই উপজেলায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে— আমরা কি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি?

বিয়ানীবাজার উপজেলার অতীত থেকে বর্তমান মৃত্যুর পরিসংখ্যানের ভয়াবহ চিত্রে দেখা যায় যে, ২০২২ সাল বিয়ানীবাজারের ইতিহাসে ভয়াবহ এক বছর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। মাত্র আট মাসে ঘটে ১৪টি আত্মহত্যা।
সেই বছরের জুলাইয়ে কলেজ শিক্ষার্থী হাজেরা বেগমের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। কয়েক দিনের ব্যবধানে জীবন শেষ করেন ১৮ বছরের তরুণ মোহাম্মদ আলী। নতুন বউয়ের মুখ দেখে এসে গলায় ফাঁস দেন কলেজছাত্রী ইয়াসমিন শাওন। জুনে আত্মহত্যা করেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানও।

সময়ের পরিক্রমায় ২০২৫ সালেও সেই মর্মান্তিক ধারাবাহিকতা থামেনি। সম্প্রতি তিন সন্তানকে রেখে জীবন শেষ করেছেন মুড়িয়া ইউনিয়নের নওয়াগাও গ্রামের রমুজ আলীর পুত্র। ফয়ছল আহমদ ।বৈরাগিবাজারের খযসিরবন্দ নয়াবাড়ির বশর মিয়ার পরিবারে গৃহপরিচারিকা মুড়িয়া ইউনিয়নের সারোপার গ্রামের মানিক মিয়ার মেয়ে তামান্না বেগম (১৭) এর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়।

এছাড়া গত ৩০ অক্টোবর বিয়ানীবাজার পৌরশহরে প্রায় ৩০ বছর থেকে বসবাস করা নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার পৌরশহরের একটি পলিথিন কারখানার মালিক আবু তাহেরের (৬০) মৃত্যুও ছিল আত্মহনন। পুলিশ জানায়, ।,তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করেছে পুলিশ।

“মানসিক স্বাস্থ্য এখন সবচেয়ে বড় সংকট” উল্লেখ করে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মনিরুল হক খান বলেন, “মানসিক স্বাস্থ্য বলে যে একটা বিষয় আছে, সেটা আমাদের সমাজে এখনো অনেকেই বুঝতে পারেন না। সংকটে পড়লে মানুষ চিকিৎসা নিতে পারেন না বা সাহস পান না— এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ।”তিনি আরো বলেন, মানসিক সমস্যার প্রাথমিক চিকিৎসা উপজেলা পর্যায়ে সহজলভ্য নয়, যা আত্মহত্যা প্রবণ মানুষদের আরও অসহায় করে তোলে।

সমাজে অবক্ষয়ের প্রতিফলন বলে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুর রহীম সবুজ মনে করেন,“আর্থ-সামাজিক উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনি বেড়েছে পারিবারিক দূরত্ব ও মানসিক চাপ। পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে— এটাই আত্মহননের পেছনে অন্যতম কারণ।”
তিনি আরো জানান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতই হোক, যদি পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না থাকে, তাহলে সমাজে মানসিক ভারসাম্য টিকে থাকে না।

পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে পারিবারিক কলহ ও আর্থিক সংকটের ইঙ্গিত বলে বিয়ানীবাজার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন জানান, এসব ঘটনায় পারিবারিক বিরোধ বা আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত সমস্যার ভূমিকা থাকতে পারে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে আর্থিক চাপ, ঋণের বোঝা এবং পারিবারিক কলহকে আত্মহননের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পুলিশের বিশ্লেষণ মতে বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ আশরাফ উজ্জামান বলেন ‘প্রতিটি ঘটনার আলাদা গল্প আছে’ “প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে আলাদা কারণ থাকে। কেউ ঋণের চাপে, কেউ পারিবারিক দ্বন্দ্বে, কেউ মানসিক যন্ত্রণায় জীবন শেষ করে। মানুষ তার অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করতে পারছে না— এটিই সবচেয়ে বড় দুঃখ।”, ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে পারলে এমন মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব।

আত্মহত্যার পেছনে,সচেতন মহলের মতে, আত্মহত্যাগুলো কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক সংকটেরও প্রতিফলন।
পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অজ্ঞতা, এবং একাকিত্বের বেড়ে যাওয়া— এই তিন কারণ মিলেই তৈরি করছে ‘নীরব আত্মহননের সমাজ’।

Explore More Districts