বাগেরহাট নিউজ ২৪

বাগেরহাট নিউজ ২৪

দেশের নদী-ভাঙন, উপকূল ও চর-হাওর অঞ্চলে দারিদ্র্য বেশি



বাগেরহাট নিউজ ২৪ ডেস্ক
প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ৩, ২০২৫, ১:৫৩ অপরাহ্ন /

বাগেরহাট নিউজ ২৪

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার মাদারীপুর জেলায়। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মাদারীপুরে দারিদ্র্যের হার ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মানে, এ জেলার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫৪ জনের বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। জেলার ডাসার উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ, যা দেশে সবচেয়ে বেশি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সেখানে দেশের সব জেলা, উপজেলা ও থানার দারিদ্র্য পরিস্থিতির তথ্য আছে।

বিবিএসের তথ্য অনুসারে, দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের হার নোয়াখালী জেলায়, ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এর মানে নোয়াখালী জেলার ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জনের মতো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। উপজেলা ও থানা বিবেচনায় রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় ৯৯ শতাংশ মানুষ গরিব নন। এখানে দারিদ্র্যের হার মাত্র ১ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সব সময় সন্দেহ আছে। গত সরকারের সময় একটি বয়ান তৈরি করা হয়েছিল যে উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্য কমেছে। এখন বিবিএসের প্রতিবেদনেও তা উঠে এসেছে। কিন্তু রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে এমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়েনি যে ওই অঞ্চলে রাতারাতি দারিদ্র্য কমবে।
নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান , সানেম
দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ড হলো দৈনন্দিন জীবন ধারণে পণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য যদি না থাকে, তাহলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন বা তাঁকে গরিব হিসেবে ধরা হবে। এটি উচ্চ দারিদ্র্যরেখা। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য পরিমাপে ১১৯ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় আনেন বিবিএস কর্মকর্তারা।

২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তি করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে বিবিএসের ওই মানচিত্রে।

দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিবিএসের উপপরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এই মানচিত্রের মাধ্যমে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দারিদ্র্য পরিস্থিতির বিশদ চিত্র পাওয়া যায়। এতে নীতিনির্ধারকদের উন্নয়ন প্রকল্প এবং সামাজিক কর্মসূচি নিতে সুবিধা হয়।

সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার এমন পাঁচটি জেলা হলো মাদারীপুর, নরসিংদী, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
অবশ্য বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সব সময় সন্দেহ আছে। গত সরকারের সময় একটি বয়ান তৈরি করা হয়েছিল যে উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্য কমেছে। এখন বিবিএসের প্রতিবেদনেও তা উঠে এসেছে। কিন্তু রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে এমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়েনি যে ওই অঞ্চলে রাতারাতি দারিদ্র্য কমবে।

সেলিম রায়হানের মতে, দেশে কিছু দারিদ্র্য পকেট আছে। যেমন নদীভাঙন, উপকূল, চর-হাওর অঞ্চল। এসব অঞ্চলে অবকাঠামো কম, যোগাযোগব্যবস্থা দুর্বল, সামাজিক সুরক্ষা কম। তাই দারিদ্র্য পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছে না। অর্থনীতির সুফল ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

বিবিএসের দারিদ্র্য মানচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রংপুর বিভাগের কোনো জেলা সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার এমন পাঁচটি জেলার তালিকায় নেই। তবে নদীভাঙন, উপকূল, চর-হাওর অঞ্চলের জেলায় তুলনামূলক দারিদ্র্যের হার বেশি। দারিদ্র্য কমার গতিও কম।

দারিদ্র্যের হার বেশি পাঁচ জেলা

সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার এমন পাঁচটি জেলা হলো মাদারীপুর, নরসিংদী, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, নরসিংদী জেলার দারিদ্র্যের হার ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া দারিদ্র্যের হার পিরোজপুরে ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ। মূলত নদী অববাহিকার জেলাগুলোতে তুলনামূলক বেশি দারিদ্র্য দেখা গেছে। গত এক যুগে মাদারীপুর, নরসিংদী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের হার এমন থানাগুলোর অন্যতম কয়েকটি হলো রাজধানী ঢাকার পল্টন, বিমানবন্দর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, উত্তরা পশ্চিম, শাহবাগ, চট্টগ্রামের ডবলমুরিং ও পাঁচলাইশ।
সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের পাঁচ জেলা

সবচেয়ে কম দারিদ্র্য এমন পাঁচ জেলা হলো নোয়াখালী, ঢাকা, মেহেরপুর, খুলনা ও ফেনী।

ঢাকা জেলার দারিদ্র্যের হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া মেহেরপুরে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, খুলনায় ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ফেনী জেলায় সাড়ে ১০ শতাংশ দারিদ্র্যের হার। গত এক যুগে এই পাঁচটি জেলার দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের হার এমন থানাগুলোর অন্যতম কয়েকটি হলো রাজধানী ঢাকার পল্টন, বিমানবন্দর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, উত্তরা পশ্চিম, শাহবাগ, চট্টগ্রামের ডবলমুরিং ও পাঁচলাইশ। এসব থানায় দারিদ্র্যের হার ২ শতাংশের কম।

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর উন্নতি

কয়েক দশক ধরে দেশের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর দরিদ্র জেলা হিসেবে পরিচিত। মঙ্গার কারণে ওই অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার দেশের ওই অন্য এলাকার তুলনায় বেশি। তবে বিবিএসের হিসাব অনুসারে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

আট বছর আগের দারিদ্র্য মানচিত্রে কুড়িগ্রাম দেশের দরিদ্রতম জেলা ছিল। আর কুড়িগ্রামের রাজীবপুর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। এবারের দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখা গেছে, কুড়িগ্রামে দারিদ্র্য হার ৩১ শতাংশের বেশি। আট বছর আগে ছিল ৭১ শতাংশ। ওই সময় দেশের শীর্ষ ১০টি দরিদ্র জেলার পাঁচটি রংপুর বিভাগের। জেলাগুলো ছিল কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। এই পাঁচটি জেলা এখন দারিদ্র্যের হার কমে ২০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যে।

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার দারিদ্র্যের হার এখন সাড়ে ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালের হিসাবে ওই উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ।

দারিদ্র্য মানচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব জেলায় অতি উচ্চ দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিদ্যমান, সেই তালিকায় আছে পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর।

মানচিত্রে দেখা গেছে, দেশে এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ। গ্রাম এলাকার দারিদ্র্য ২০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

আলোচনা

দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, সারা দেশের উপজেলা পর্যন্ত দারিদ্র্য পরিস্থিতি জানা গেছে। এখন নীতিনির্ধারকেরা এলাকাভিত্তিক পৃথক পরিকল্পনা করতে পারবেন।

বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) উপপ্রধান সিমোন লসন পার্চমেন্ট। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। দারিদ্র্য বিমোচনকে অগ্রাধিকারে আনতে হবে। এ জন্য পরিকল্পনা দরকার।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার বেশি এমন এলাকায় আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। আয় বাড়লে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য আসবে।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, জাতিসংঘ ও উন্নয়ন সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, বিবিএসের কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

Explore More Districts