বাঁধ বধ প্রাণ-প্রকৃতি

বাঁধ বধ  প্রাণ-প্রকৃতি

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে
জামালগঞ্জের পাগনা হাওরের সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্লোজার বৌগলাখালি বাঁধ। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে এ ক্লোজারটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, ব্যয়বহুল এবং পরিবেশগত সমস্যার কারণও। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা দুই জেলার প্রায় সহ¯্রাধিক কৃষকের ফলন নিরাপত্তায় বৌগলাখালি বাঁধের সংস্কার ও মেরামত করে আসছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বাঁধটি মেরামতে প্রতিবছর অঢেল অর্থ ব্যয় হয় সরকারের। কিন্তু এতে নদীর স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি কৃষি ও কৃষকের টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। নদীর গতিপথ সচল রেখে বৌগলাখালি অংশে পরিকল্পিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি স্থানীয় কৃষকদের।
সম্প্রতি পাগনা হাওর ও বৌগলাখালি বাঁধ ঘুরে এবং খোঁজ খবর নিয়ে দেখা গেছে, এ বছর পাগনা হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বৌগলাখালি বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে সুরমা নদীর প্রায় সন্নিকটে। এর আগের বছর আরেকটু ভেতরের অংশে একই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। সে বাঁধের ভাঙ্গা স্থানে গভীরতা বেশি হওয়ায় এ বছর একটু সামনে এগিয়ে সুরমা নদীর প্রায় তীরবর্তী স্থানে সেটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। সুরমা নদী থেকে হাওরমুখী বাঁধ কিংবা পিয়াইন নদীর এ সংযোগস্থলটি দেখলে মনে হবে এটি মড়া খাল। কিন্তু না, খালসদৃশ্য সরু এ ধারাটি পিয়াইন নদে গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলেছে। তার মধ্য দিয়ে সুরমার সাথে মিলিত হওয়া পিয়াইন নদী ১২ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমিতে বিস্তৃত পুরো পাগনা হাওরটি বেষ্টন করে রেখেছে।
পথিমধ্যে পিয়াইন নদী সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ইউনিয়নের আলীপুর অংশ দিয়ে প্রবেশ করে দিরাই উপজেলার বাংলাবাজার, ভাটিপাড়া ও নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি এবং ভীমখালী ইউনিয়নের কলকতখাঁ, হুগলি, সন্তোষপুর নোয়াগাঁও হয়ে ফের সুরমা নদীতে পতিত হয়েছে। দুই জেলায় ঢুঁ মারা পিয়াইন নদের সম্মুখস্থল আলীপুর অংশে বৌগলাখালি বাঁধ দিয়ে প্রতিবছর নদী বিলীনের পথ সুগম করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ এর খসড়া থেকে জানা যায়, খসড়াটির তৃতীয় অধ্যায়ের ১৩ নম্বর ধারার ‘জ’ নম্বর কার্যাবলীতে নদীর পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে কমিশন যথোপযুক্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছে। পাশাপাশি ‘ঝ’ নম্বর কার্যাবলীতে কমিশন দেশের নদী রক্ষাকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করার বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছে।
খসড়ার চতুর্থ অধ্যায়ের ১৮ নম্বর ধারার ৩ নম্বর উপধারায় নদীর পানি ও পরিবেশ দূষণ এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করাকে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে নদী রক্ষা কমিশন। কিন্তু সেই আইনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর নদীর পানিপ্রবাহ আটকে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত দায়সারাভাবে বৌগলাখালি অংশে বাঁধ করে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে নদীর পানিপ্রবাহ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাওর ও নদী সচেতন মানুষেরা।
কৃষক, হাওর ও পরিবেশ সচেতন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাওরের পানি নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধার জন্য নদী বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য। হাওর ও নদী উভয়েরই নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা প্রয়োজন। পাউবো একদিকে নদী খনন করছে, আরেকদিকে তার উৎসস্থলে বাঁধ দিয়ে নদীর আয়ু টেনে ধরছে। খর¯্রােতা সুরমা ও পাগনা হাওরবেষ্টিত পিয়াইন নদের উৎসমুখে প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ করে যেভাবে পানিপ্রবাহ রোধ করা হচ্ছে তাতে নদীর ভারসাম্য বজায় থাকছে না।
একদিকে অকাল বন্যার কবল থেকে হাওরের ফসল রক্ষা যেমন অনিবার্য তেমনি নদীর পরিবেশ সংরক্ষণও জরুরী। পাউবোর নদী ধ্বংস করার নীতি পরিহার করে বৌগলাখালি ক্লোজারসহ হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাঁধ ব্যতীত পরিকল্পিত টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণে মনযোগী হওয়ার তাগিদ অনেকের। এ জন্য হাওর ও নদী নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তি, সংস্থা এবং হাওরপাড়ের মানুষের সাথে কথা বলে জরুরী উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ।
হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে নিয়োজিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, বৌগলাখালি বাঁধে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই পিআইসিতে পাউবো বরাদ্দ দিয়েছে যথাক্রমে ২০ লাখ ৪১ হাজার ও ১৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই পিআইসিতে বরাদ্দ ২০ লাখ ৭৬ হাজার ও ১৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২২ লাখ ১৯ হাজার ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। বৌগলাখালি বাঁধে দিন দিন বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এখানে প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে আসছে। কিন্তু হাওর, নদী ও কৃষকের স্থায়ী কোন সমাধান হচ্ছে না।
বিগত কয়েক বছর ধরে বৌগলাখালি বাঁধে পিআইসির কাজ করে আসা কৃষক মো. আসাদ আলী বলেন, ‘পাগনা হাওরের ফসলের লাগি বৌগলাখালি বাঁধ খুবই জরুরী। তবে বাঁধ না দিয়া এইখানে বড় একটা ¯øুইস গেইট দেওয়া দরকার। যাতে কইরা নৌকাও যাইতে পারে, চারপাশের পরিবেশও ঠিক থাকে। তাইলে সব দিক দিয়াই ভালা হইব। প্রতিবছরই এইখানে (বৌগলাখালি বাঁধে) মন্ত্রী-মিনিস্টার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকেরা আসেন। কিন্তু কিচ্ছু তো হয় না।’
হাওর ও কৃষকবান্ধব ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ফেনারবাঁক ইউপি সচিব অজিত রায় বলেন, পাগনা হাওরের জন্য বৌগলাখালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। কয়েকটা উপজেলার প্রায় শত কোটি টাকার ফসলের সাথে বাঁধটার সম্পর্ক। এভাবে প্রতিবছর বাঁধে যে মাটি দেওয়া হয়, সে মাটি হাওর ও নদীতে গিয়ে পড়ে। এতে হাওর-নদী দুই জায়গারই দীর্ঘ ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় বৌগলাখালি পয়েন্টে নৌ ও পানি চলাচলের সুবিধা রেখে সুপরিকল্পিতভাবে ¯øুইচ গেইট নির্মাণ করা জরুরী।
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ও পাগনা হাওরপাড়ের বাসিন্দা অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, বছরের পর বছর মাটি কেটে হাওরপাড়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ যেমন বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি নদীমুখে বাঁধ দিয়ে তার প্রবাহধারা বন্ধ করা হচ্ছে। এ রকম বাঁধের কারণে হাওর ও নদী উভয় ক্ষেত্রেই বিপদ তেড়ে আসছে। বৌগলাখালি অংশে প্রতিবছর এভাবে বাঁধ না দিয়ে নৌ চলাচলের সুবিধা রেখে আধুনিক রেগুলেটর (¯øুইচ গেইট) নির্মাণ করা দরকার।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, নদীর উৎসমুখে বাঁধ দেওয়া নদী রক্ষা কমিশন আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। পাউবো যদি হাওর রক্ষা বাঁধের নামে নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে এখানকার জলজ প্রাণ, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ বিষয়গুলো দেখার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতি আহŸান জানাই।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, ‘কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় বৌগলাখালিতে ছয় মাসের জন্য আমরা বাঁধ দিচ্ছি। ফসল তোলার পর সে বাঁধ কেটে দেওয়া হয় কিংবা ভেঙে যায়। তখন তো নদীর ক্ষতি হয় না। বাঁধটি থাকলে হয়তো ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল।’ অন্য প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘এখানে রেগুলেটরসহ বোট পাস (নৌকা চলাচলের সুবিধা) করা হবে। এটি পরিকল্পনাধীন আছে। তখন সেখানে আর বাঁধ থাকবে না।’

Explore More Districts