বিশেষ প্রতিনিধি
বন্যায় জেলার দুই লাখ কৃষকের ধানের গোলায় (উগার বা ভাড়ার) পানি লেগেছে। এ কারণে কমপক্ষে এক লাখ টন ধানের ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। অবশ্য স্থানীয় কৃষি বিভাগের দাবি পানি লেগেছে গোলায় থাকা আটারশ টন ধানের। সেগুলোও শুকিয়ে খাওয়ার উপযোগী করার চেষ্টা করছেন কৃষকরা।
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে গেল ১৬ জুন জেলার বেশিরভাগ এলাকা বন্যা কবলিত হয়। ১৭ জুন ভোর তিনটায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যায় জেলার ৮০ ভাগেরও বেশি এলাকা। তালা দেওয়া অনেক দু’তলা গুরুত্বপূর্ণ অফিস, হাসপাতাল ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের তালা ভেঙে জীবন বাঁচিয়েছেন লাখো মানুষ। ভয়াবহ বন্যার তা-বে বসতঘর ডুবে যাওয়ায় ঘরে থাকা ধানের গোলাও ডুবেছে।
জেলার তিন লাখ ৭৮ হাজার সাতশ কৃষকের মধ্যে কমপক্ষে দুই লাখ কৃষকের গোলায় পানি লেগেছে। কারো কারো গোলার উপরের অংশ পর্যন্ত পানি ছিল। ডুবে থাকা এসব ধান পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, গেরা ওঠে গেছে, শুকানোর জায়গাই পাচ্ছেন না কৃষকেরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক জব্বার মিয়া বললেন, ঘরে বুক সমান পানি হবার পর, কোন লাখান নাওয়ে (নৌকায়) জান (প্রাণ) লইয়া মহাসড়কে গিয়া ওঠছি। ধান, পান, থালা-বাসন কোন বায়দি চাওয়ার উপায় আছিল না, ছয়দিন পরে ঘরও আইয়া হাঁটু সমান পানি দেখছি, ধানে পচা গন্ধ বারাইছে, কিচ্ছু করতাম পারছি না। কোনানো নিতাম, কেমনে নিতাম, উগারো পইচ্ছা যার ধান, ঘেরা অইগিছে। অখন শুকাইলেও কোন কাম অইতো নায়।’
এই গ্রামের সালাম উদ্দিন, জমির হোসেন, আব্দুল হামিদ, ফিরোজ আলী, মুকিত মিয়া, সাজাউর রহমানসহ ২৪০ পরিবারের গ্রামের ১৮০ পরিবারের ধানের গোলা ডুবে গেছে। কারো কারো গোলা ফেটে বা ভেঙে ভেসে গেছে শত শত মণ ধান।
সুনামগঞ্জ শহরতলির হাছনবাহার গ্রামের কৃষক সাবাজ মিয়া ও সাঈদুল মিয়া বললেন, ‘গেল বৈশাখে ধান কাটতে কাটতে ক্ষেত পানি আইয়া ধানের ক্ষতি করছে। কষ্ট কইরা যেগুন উগারো তুলছিলাম ইগুন উগার ভাইঙ্গা ভাইস্সা গেছে, যেগুন আছে পচি গেছে। অখন আমরারে খাওনের বেপানার (মহা বিপদে) মধ্যে পালাইদিছে।’
এই অবস্থা কেবল ইসলামপুর বা হাছনবাহার গ্রামে নয়। জেলার দুই হাজার ৮৮৭ গ্রামের দুই হাজার গ্রামেরই একই চিত্র।
জেলার দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বড় কৃষক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য আব্দুস ছাত্তার বললেন, ‘আমার ধানের গোলা উঁচু থাকায় পানি ওঠেনি। পানি আর গোলায় প্রায় সমানে সমানে ছিল। ৯০ ভাগ কৃষকের ধানের গোলায় পানি লেগেছে, কারো কারো গোলা ডুবে গিয়েছিল। এখনও ধান শুকানোর জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, আমার আঙ্গিনা পাকা থাকায়, আঙ্গিনা ভাসতেই প্রতিদিন অসংখ্য কৃষক ফোন দিচ্ছেন আঙ্গিনা ধান শুকাতে ব্যবহারের জন্য, কয়জন এক আঙ্গিনায় ধান শুকাবেন। আমার পাশের চ-িপুর গ্রামে কমপক্ষে ১০ হাজার মণ ধান পানির নীচে ছয় থেকে সাত দিন ছিল। সব মিলিয়ে ভাটি এলাকায় গোলার ২৫ ভাগ ধান পানির নীচে ছিল। এরমধ্যে ১০ ভাগ ধান খাওয়ার উপযোগীই হয়তো করা যাবে না, কৃষকরা ভিজা ধান খাওয়ার উপযোগী করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বললেন, জেলায় এবার তিন লাখ ৭৮ হাজার সাতশ’ কৃষক মিলে ১৩ লাখ টন ধানের উৎপাদন করেছিলেন। ৪০ ভাগ ধান ইতিমধ্যে বিক্রয় করেছেন কৃষকরা। গোলায় পানি লাগলেও ১৮ শ’ থেকে দুই হাজার টনের বেশি ধানের ক্ষতি হবে না। বন্যার পানি নামতেই ভেজা ধান উঁচু স্থানে নিয়ে শুকিয়ে খাবার উপযোগী করছেন কৃষকরা।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে, কৃষকদের গোলার কি পরিমাণ ধান নষ্ট হবে, সেই তথ্যও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তুলে আনবেন।
