অবশেষে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে মানবতার বাতিঘর খ্যাত চাঁদপুর পৌরসভার শতবর্ষী দাতব্য চিকিৎসালয়। চিকিৎসক সঙ্কটের অযুহাতে দীর্ঘ ১ মাস ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে গরিবের চিকিৎসাসেবার এই প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে নদী ভাঙ্গন আর দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করা এই এলাকার হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাপা ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ১০৫ বছরের পুরনো এই চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রটি ফের চালু করার দাবি জানিয়েছে পুরানবাজারের সচেতন মহল।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা পুরানবাজারের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ২৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পৌর দাতব্য চিকিৎসা। ব্রিটিশ সরকার, পাকিস্তান সরকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শাসনামলে বুক চিতিয়ে স্বগৌরবে এই প্রতিষ্ঠানটি নামমাত্র মূল্যে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিল। সবশেষ চাঁদপুর পৌরসভার অর্থায়নে মাত্র ২ টাকার টিকেটে চিকিৎসা ও ঔষধ দিয়ে মানবতার বাতিঘর হিসেবে সমগ্র দেশজুড়ে ব্যাপক সুনাম এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে এই প্রতিষ্ঠানটি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে চাঁদপুর পৌরসভার ভূয়সি প্রশংসা করে সংবাদ প্রচার করা হয়। প্রথম দিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিতে অপারেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা দেয়া হতো। পরবর্তীতে অর্থ সঙ্কটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও পৌরসভার ২ জন স্বাস্থ্য সহকারী রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার কার্যক্রম চলমান ছিল। এতে হতদরিদ্র মানুষের ছোটখাট অসুখের চিকিৎসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে দাতব্য চিকিৎসালয়। এদিকে হঠাৎ করেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঙ্কটের অযুহাত দেখিয়ে গেল সেপ্টেম্বর মাসে পৌর দাতব্য চিকিৎসালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে হতদরিদ্র মানুষজন পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
সোমবার সকালে দাতব্য চিকিৎসালয়ের বারান্দায় বসে থাকা বৃদ্ধা করিমজান বলেন, ৫০ বছর ধইরা আমি এইখানে ডাক্তার দেখাই। কয়দিন ধইরা আইয়া ফিরা যাই। ডাক্তার নাই। তারা দেওয়া। আমার এই বয়সে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। এইডা বন্ধ হইলে আমরা কি যামু।
স্থানীয় বাসিন্দা বিএনপি নেতা দুলাল খান বলেন,
পৌরসভার অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান শত বছর ধরে স্থানীয় খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি পাশ্ববর্তী চরাঞ্চলের অসহায়দের চিকিৎসার ভরসা ছিল। দেশের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই দাতব্য চিকিৎসালয়ে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে অসহায় মানুষরা স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসতো। কিন্তু অজানা কারণে এটিও বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা বার বার দাবি করেছিলাম এখানে অবকাঠামো উন্নয়নসহ অন্তত সপ্তাহে একদিন হলেও একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন তো দূরের কথা চিকিৎসক সংকটের দোহাই দিয়ে এটি বন্ধ করেই দিয়েছে । আমরা পৌর প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের প্রতি আহ্বান থাকবে, যতদ্রুত সম্ভব এখানে চিকিৎসক এনে দাতব্য চিকিৎসালয়টি কার্যক্রম পূণরায় শুরু করা হোক।
স্থানীয় ১ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম নজু বেপারী বলেন, পুরানবাজারে অনেকগুলো কলোনি এবং নদী ভাংতি দরিদ্র এলাকা রয়েছে। এসব এলাকার গরীব মানুষরা একশো বছর ধরে এই দাতব্য চিকিৎসালয়ে সেবা পেয়ে আসছে। কিন্তু কি কারণে, কোন উদ্দেশ্যে এটি বন্ধ করা হলো, আমাদের জানা নেই। প্রয়োজনে টিকেটের মূল্য বাড়িয়ে হলেও দ্রুত এটি চালু করার দাবি জানাই।
চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য সচিব ও দক্ষিণ অঞ্চল নদী ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, এখানে দীর্ঘদিন এমবিবিএস ডাক্তার ছিল। স্বাস্থ্য সহকারীর মাধ্যমে টিকাকেন্দ্রসহ স্বাস্থ্য সেবা বহাল ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই জনস্বার্থের বিপরীত গিয়ে কেন এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো। আমরা মনে করি এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা অন্যায় কাজ হবে। পুরান বাজারের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার কেন্দ্র এটি। তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পৌর প্রশাসকের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
এ বিষয়ে চাঁদপুর পৌরসভার প্রশাসক মো. গোলাম জাকারিয়া বলেন, দাতব্য চিকিৎসালয়টি পৌর অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসছিল। মূলত এখানে কোন চিকিৎসক না থাকায় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগে দুইজন স্বাস্থ্য সহকারী এটি পরিচালনা করতেন। চিকিৎসক না থাকলে কিভাবে রোগী দেখবেন, মানুষেরস্বাস্থ্যসেবা কিভাবে নিশ্চিত হবে। আমরা সিভিল সার্জনের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। চিকিৎসক সংকট দূর হলে যাতে সহসাই সেখানে একজন চিকিৎসক দেওয়া হয়। আশা করছি চিকিৎসক পাওয়া গেলে দ্রুত এটি আবার চালু করা হবে।
প্রতিবেদক:আশিক বিন রহিম/ ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫