কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় পদ্মা নদীর চরের চারটি জায়গা থেকে মিলন হোসেন (২৭) নামে এক যুবকের লাশের ৮টি টুকরা উদ্ধারের ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে মামলায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মিলনের মা শেফালি খাতুন বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।
রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) নতুন করে একজনসহ মোট ৬ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। কুষ্টিয়া মডেল থানার উপপরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (এসআই) সাজু মহন সাহা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, এসকে সজিব ওরফে সজিব শেখ ছাড়াও জহির রাইহান, ফয়সাল আহমেদ, ইফতি খান, সজল ইসলাম ও নতুন করে আটক লিংকন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাদের সঙ্গে আরও ৩ থেকে ৪ জন হত্যা ও লাশ গুমে অংশ নেয় বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। এর মধ্যে কয়েকজন পলাতক আছে। এসকে সজিবের পেছনে কারা আছে তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না পুলিশ তাও তদন্ত করে দেখছে।
তিনি আরও বলেন, আটককৃতদের যাচাই বাছাই চলছে। আটক ছয় জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য কয়েকজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে একাধিক আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজী হয়েছে। বাকিদের রিমান্ড চাওয়া হবে।
রোববার দুপুরে শহরের হাউজিং এলাকায় এসকে সজিবের ভাড়া বাসায় গিয়ে কথা হয় তার মা, বোন ও স্ত্রীর সঙ্গে। সজিবের মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন।
তিনি বলেন, আমার ছেলে মারধর-মারামারি করে এটা ঠিক আছে। তবে হত্যা করতে পারে এটা বিশ্বাস করি না। তার অনেক শত্রু আছে কেউ তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। তুষারের সঙ্গে (জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি) আমার ছেলে রাজনীতি করে। সে যখন ডাকে আমার ছেলে চলে যায়। একসঙ্গে বালু ঘাটে ব্যবসাও আছে, আমাদের পরিবারের সকল খরচও তুষার দেয়। সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। সে বেশ কয়েকবার মাদকসহ অন্য অপরাধে গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছে বলে স্বীকার করেন তার মা।
তিনি বলেন, আমাদের বাসায় অনেক ছেলেরা আসে। সজল ও আসতে পারে। তবে নিহত মিলনের সঙ্গে আমার ছেলের কোনো ব্যবসা ছিল না। বন্ধুরা তাকে ডেকে নিয়ে যেতে পারে।
মিলনের এক বোন বলেন, শুনেছি ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছে। এর মধ্যে নিবিড়সহ কয়েকজনের নাম বলেন তিনি। তারা ঢাকায় পলাতক বলে জানায় সে। আমার ভাই তুষারের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে যখন ডাকে আমার ভাই ছেলে-পেলে নিয়ে মিছিল মিটিংয়ে যায়। আমার ভাই লোকজনকে মারধর করে এমন বিষয় আমরা জানি, তবে হত্যার মতো ঘটনায় সে জড়িত বলে আমরা বিশ্বাস করি না।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্ ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ বলেন, টাকা-পয়সার বিষয় নিয়ে মিলন হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে বলে গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে। এর পেছনে আরও কারা-কারা আছে, টাকা-পয়সা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসকে সজিবসহ যে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা ছাড়া আরও বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রপাতি ছাড়াও আলামত জব্দ করা হয়েছে। আসামিদের বেশ কয়েকজন আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজী হয়েছে। এছাড়া অন্যদের রিমান্ড চাওয়া হবে।
এসকে সজিবের অপরাধ জগতের বিষয়ে তিনি বলেন, সজিবের বিরুদ্ধে থানায় ১১টি মামলা আছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলা শেষ হয়ে গেছে। তার জেল হয়েছিল একটি মামলায়। তার বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং পরিচালনাসহ মাদক কারবারের অভিযোগও আছে। অনেকে মারধর ও হয়রানির শিকার হলেও তাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় অভিযোগ দিতে সাহস করে না। তাই তারা পার পেয়ে যায়। আমাদের কাছে অভিযোগ আসা মাত্র ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। মিলন হত্যার সঙ্গে সজিবসহ তার সহযোগীরা জড়িত। এছাড়া সজল নামে মিলনের যে ব্যাবসায়িক পার্টনার ছিল বলে সেও এ ঘটনার আরেকজন মাস্টার মাইন্ড। সজিব ও সজলের পরিকল্পনায় হত্যা ও লাশগুমের ঘটনা ঘটে।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার দিনগত রাত ১২টা থেকে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পদ্মার চরে অভিযান চালিয়ে মিলন হোসেনের লাশের টুকরাগুলো উদ্ধার করে পুলিশ। মিলন হোসেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাহিরমাদি গ্রামের মাওলা বক্স সরদারের ছেলে। তিনি স্ত্রী মিমি খাতুনকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং ই ব্লকে ভাড়া বাসায় থাকতেন। টেক্সটাইল প্রকৌশলে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন।
গত বুধবার সকালে এস কে সজিব নামের এক যুবকের ফোনকল পেয়ে তিনি শহরের ভাড়া বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। ওই সন্ধ্যায় মিলনের স্ত্রী কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন বাড়ি থেকে অনলাইনে কাজ করতেন। নিখোঁজের দিন তাকে মুঠোফোনে ডেকে হাউজিং এলাকার একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ওই রাতে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করার সুবিধার্থে ধারালো অস্ত্র দিয়ে লাশ টুকরা টুকরা করা হয়। চারটি মোটরসাইকেলে সাতজন সাতটি পলিথিন ব্যাগের ভেতর লাশের নয় টুকরা অংশ নিয়ে বের হন। নদীর পাড় থেকে হেঁটে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পদ্মার মধ্যে বালুর ভেতর চারটি স্থানে লাশের টুকরোগুলো পুঁতে রাখেন তারা। এ পুরো হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এস কে সজিব।