চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভূজপুরের বাসিন্দা প্রবাসে নিহত ভাইয়ের মরদেহের সাথে লাশ হয়ে ফিরল আরও দুই ভাই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে মা তার প্রবাসী সন্তানের লাশ দেশে ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসেছিলেন, তার বাড়িতে একে একে এলো তিন সন্তানের কফিন। বিদেশ থেকে ফেরা মেঝ ছেলের লাশের সাথে এলো বড় ছেলে আর আদরের ভাগ্নের নিথর দেহ। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির তালুকদার পাড়ার আনোয়ারা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদে শনিবার মধ্যরাতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। সন্তানহারা এই মায়ের কান্না দেখে সেদিন নিরবে চোখের জল ফেলেছে হাজারো মানুষ।
গাড়ি থেকে যখন একে একে তিনটি লাশের খাটিয়া নামানো হলো, আনোয়ারা বেগম যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। বাকশক্তি রুদ্ধ, চোখে রাজ্যের শূন্যতা। এগিয়ে এসে কাঁপাকাঁপা হাতে স্পর্শ করলেন কফিনগুলো। এরপর বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে বিলাপ করছিলেন, ‘বাবা, একবার কথা বল, শুধু একবার। তোরা না বলেছিলি ভাইয়ের লাশ নিয়ে আসবি… তোরা কেন কথা বলছিস না?’ কিন্তু সন্তানদের কাছ থেকে আর কোনো উত্তর মেলেনি। আনোয়ারা বেগম বুঝে গিয়েছিলেন, এই খাটেই চিরনিদ্রায় শায়িত তার আদরের সন্তানেরা।
পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে গত বছর সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন আনোয়ারার মেঝ ছেলে মোহাম্মদ রুবেল (২৭)। কিন্তু সেখানে সামান্য একটি বার্গার খাওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায় দোকান মালিকের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গত বছরের ১৭ জুলাই রুবেল মারা যান। দীর্ঘ এক বছরের আইনি লড়াই শেষে শনিবার তার নিথর দেহ দেশে ফেরে।
ভাইয়ের লাশ গ্রহণ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন বড় ভাই মোহাম্মদ বাবুল (৩৭) ও তাদের ফুফাতো ভাই মো. ওসমান গণি (৩৫)। বিকেলে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি যখন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসা এলাকায় পৌঁছায়, তখনই ঘটে আরেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান মোহাম্মদ বাবুল এবং ওসমান গণি। যে ভাই ছোট ভাইয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরছিল, সেই ভাইয়ের লাশও ফিরল একই অ্যাম্বুলেন্সে।
নিহত বাবুলের স্ত্রী সাহেদা আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। অবুঝ দুই কন্যাসন্তানকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে বলছিলেন, ‘আমি এখন আমার সন্তানদের কী জবাব দেবো? কী নিয়ে বাঁচব আমি? কে দেবে তাদের সান্ত্বনা?’
অন্যদিকে, নিহত ওসমানের স্ত্রী নুসরাত জাহান শিমার পৃথিবীও যেন থমকে গেছে। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগেও ফোনে কথা হলো, বললেন লাশ নিয়ে ফিরছেন। কিন্তু তিনি নিজেই ফিরলেন কফিনে বন্দি লাশ হয়ে।’ দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন, সেই উৎকণ্ঠায় তিনি নির্বাক।
১৭ বছর বয়সী ছোট বোন রুম্পা আক্তারের কান্নাজড়িত কণ্ঠের আকুতি যেন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল, ‘ভাইয়েরাই ছিল আমাদের সব ভরসার জায়গা। বাবা-মায়ের আশ্রয়। হে আল্লাহ, আমাদের এ কী করলে তুমি? শনিবার মধ্যরাতে তিনটি লাশ যখন একে একে গ্রামে পৌঁছায়, তখন পুরো তালুকদার পাড়ায় নেমে আসে শোকের ছায়া। আজ রবিবার জানাজা শেষে লাশের পেছনে পেছনে কবরস্থান পর্যন্ত ছুটে চলে হাজারো মানুষ। নিঃশব্দে আহাজারি আর চোখের জলে তারা বিদায় জানায় তিন সন্তানকে, যাদের জীবনের গল্প শেষ হলো এক অকল্পনীয় ট্র্যাজেডিতে।
এমজে/সিটিজিনিউজ