রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তরে যারা নিযুক্ত হন, যারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সেবা প্রদানের দায়িত্বে থাকেন—তাঁরা সকলেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। অর্থাৎ, তারা জনগণের টাকায় নিযুক্ত সেবাদানকারী। জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা, এবং পদ-পদবি। তাই তাদের অবস্থান হওয়া উচিত—সেবক, কখনোই স্বর্বভৌম প্রভু নয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যুগের পর যুগ ধরে একটি অসংগতি আমাদের সমাজে রপ্ত হয়েছে। যে কর্মচারী জনগণের সেবায় নিযুক্ত, তিনিই যেন জনগণের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেন। তাঁর আচরণ, কথাবার্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকাশ পায়—তিনি যেন রাষ্ট্রের অধিপতি, আর সাধারণ মানুষ তাঁর অধীনস্থ প্রজা!
চাকরি পাওয়ার আগে এই ব্যক্তিরা বলেন, “আমাকে সুযোগ দিন, আমি জনগণের সেবা করবো।” কিন্তু সুযোগ পাওয়ার পর, সে কথাগুলো হারিয়ে যায় ধোঁয়ায়। কলম হাতে, চেয়ারে বসে, কিছু সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে, অনেকেই নিজেকে উক্ত এলাকার শাসক, নিয়ন্ত্রক, এমনকি ‘ভূপতি’ বলে ভাবতে শুরু করেন। তখন আর তাঁরা মনে রাখেন না যে তিনি একজন “প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী”, সেবাদানকারী—নয় কোনো রাজা।
এমন আচরণ শুধু সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, নৈতিক ও ধর্মীয় বিবেচনাতেও গুরুতর অন্যায়। আপনি যখন নিজেকে জনগণের উপরে ভাবেন, তাদের কথা শুনতে চান না, তাদের সেবা করতে অনীহা দেখান, তখন আপনি নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছেন, নিজের আত্মার প্রতিও অবিচার করছেন। আপনার দায়িত্ব জনগণের প্রতি, তারা আপনার কর্তা, আপনি তাদের কর্মচারী—এই উপলব্ধি যদি প্রতিটি সেবাদানকারীর মধ্যে না জাগে, তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশ বারবার এক ধরনের পরিবর্তনের মুখে পড়বে। জনগণের ক্ষোভ, হতাশা, ক্ষরণ—সবকিছু একদিন ফুঁসে উঠবে।
আজ মানুষ বলে, “সুশাসন চাই, জবাবদিহিতা চাই, স্বচ্ছতা চাই, মানবাধিকার চাই।” এসব দাবি নতুন কিছু নয়। এগুলো সংবিধানেই জনগণের অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু যখন সেই অধিকারগুলো রাষ্ট্রের কর্মচারীরাই খর্ব করতে শুরু করেন, তখন তা একটি গোটা জাতির জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র চাই, তাহলে সর্বপ্রথম প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি কর্মচারীকে নিজের পরিচয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে—“আমি জনগণের টাকায় নিযুক্ত, আমি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণই আমার মালিক”।
এই উপলব্ধি যতদিন না প্রত্যেকের অন্তরে প্রোথিত হবে, ততদিন পর্যন্ত উন্নয়ন হবে বাহ্যিক, কিন্তু ভেতরের পচন বাড়তেই থাকবে।