বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা জেলার সাভারে পুলিশের সাজোয়া যানের ওপর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মিলিটারি ইন্সটিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) এর শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। পরিবারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মামলাও দায়ের করা হয়। তদন্তের স্বার্থে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের ভিত্তিতে আদালত ইয়ামিনের মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে বাবা-মায়ের আপত্তির মুখে কবর থেকে উত্তোলন করা যায়নি ইয়ামিনের মরদেহ।
মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আদালতের নির্দেশে মরদেহ উত্তোলনের জন্য সাভারের ব্যাংক টাউন কবরস্থানে যান ম্যাজিস্ট্রেট, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা। এ সময় তাদের তীব্র আপত্তির মুখে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনের কার্যক্রম স্থগিত করেন ঢাকা জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আলী হাসান।
এ ঘটনার পর নিহত ইয়ামিনের মামা আব্দুল্লাহ আল মুন কাদির বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের ভিত্তিতে দাফনের ৬ মাসেরও বেশি সময় পর কবর থেকে ইয়ামিনের লাশ তোলার সময় পরিবারের বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত কবর থেকে লাশ তুলতে ব্যর্থ হন সংশ্লিষ্টরা। বাদী আব্দুল্লাহ আল মুন কাদির পরিবারের আপত্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
নিহত ইয়ামিনের মামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুন কাদির বলেন, ইয়ামিনের বাবা-মা কোনভাবেই এটার (লাশ উত্তোলন) জন্য রাজি হচ্ছে না। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মামলার স্বার্থে যেটা দরকার সেটাতে রাজি আছে। ওর বাবা মাকে আসলে আমরা রাজি করাতে পারছি না।
কর্তব্যরত সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আলী হাসান উপস্থিত সংবাদকর্মীদের বলেন, ইয়ামিনের বাবা-মায়ের আপত্তির কারণে লাশ উত্তোলন স্থগিত করা হয়েছে। তারা আমার কাছে একটি ফর্মাল আবেদন করেছেন। সেই আবেদনে ওনারা উল্লেখ করেছে, শহীদ ইয়ামিন শহীদি মর্যাদা পেয়েছে বিধায় তারা কবর থেকে লাশ উত্তোলন করতে আপত্তি জানিয়েছেন। বিষয়টি আমরা বিজ্ঞ আদালতকে অবহিত করব। পরবর্তীতে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
শিক্ষার্থী ইয়ামিন হত্যা মামলাটি ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামের আদালতে গত ২৫ আগস্ট দায়ের করেন নিহতের মামা আব্দুল্লাহ আল মুন কাদির। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সাভার থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরে সাভার থানা মামলাটি রুজু করে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, নিহত শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৮ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে সাভার বাজার বাস স্ট্যান্ডে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে। তাঁরা শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে ধরে টেনে পুলিশের সাঁজোয়া যানের কাছে নিয়ে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে বুকের বাঁ পাশে গুলি করেন। গুলিতে ইয়ামিনের বুকের বাঁ পাশে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। এমতাবস্থায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ইয়ামিনকে টেনে সাঁজোয়া যানের ওপরে ফেলে রেখে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য গাড়িটি এপাশ থেকে ওপাশ প্রদক্ষিণ করতে থাকে। ইয়ামিনকে প্রায় মৃত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেয় এবং সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে একজন পুলিশ সদস্যকে বের করে তাঁর পায়ে পুনরায় গুলির নির্দেশ দেয়। ওই পুলিশ সদস্য ইয়ামিনকে মৃত ভেবে পায়ে গুলি না করে রাস্তার ওপরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে রোড ডিভাইডারের পাশে ফেলে দেয়। গুলিবিদ্ধ শাইখ ইয়ামিনকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচণ্ড কষ্টে নিশ্বাস নিতে তখনো দেখা যায়। পুলিশ সদস্যরা ধরাধরি করে উঁচু রোড ডিভাইডারের একপাশ থেকে আরেক পাশ ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে তাঁকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্ ও ট্রাফিক, উত্তর বিভাগ) আব্দুল্লা হিল কাফী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুলসহ ৪৯ জনকে আসামি করা হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের সাভারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে পুলিশের সাঁজোয়া যানের উপরে উঠে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকার এমআইএসটি’র কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন।
