নজরকাড়া পাহাড়ি প্রাকৃতিক ঝরনা এবং সমুদ্র সৈকতের কারণে সীতাকুণ্ডের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটন স্পটগুলো দেখতে শত শত পর্যটক ছুটে আসছেন। তবে পাহাড়ি ঝর্ণা ও সমুদ্রে নামার সময় সতর্কতার অভাবে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন স্পটগুলোতে পাঁচ কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। হচ্ছে প্রাণহানি। সীতাকুণ্ডের পর্যটন স্পটগুলোতে গত দুই মাসে পৃথক দুর্ঘটনায় ছয় পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন ঝর্ণায় পড়ে। আর তিনজনের মৃত্যু হয়েছে সাগরে সাঁতার কাটতে নেমে। সর্বশেষ গত বুধবার সকালে উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বিলাসী ঝর্ণায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এ কে এম নাইমুল হাসান (২০) নামের এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। গত দুইমাসে যে ছয়জন মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনজনই আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ছাড়া একজন ছাড়া অন্য সবাই শিক্ষার্থী।
স্থানীয়ভাবে, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ আগস্ট উপজেলার বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের ছোট দারোগাহাট এলাকায় সহস্রধারা–২ নামের ঝর্ণা থেকে নৌকাযোগে লবণাক্ষ লেকে ফিরছিলেন ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকা থেকে আসা তিন পর্যটক। লেকটির প্রায় শেষ প্রান্তের কাছাকাছি এসে এক পর্যটক সাঁতার কেটে কূলে আসার ইচ্ছা পোষণ করে পানিতে নেমে পড়েন। তাঁর সঙ্গে সাঁতার কম জানা তাঁদের বন্ধু সোহানুর রহমানও সাঁতার কাটবেন বলে নৌকা থেকে ঝাঁপ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর পানিতে তলিয়ে যান সোহান। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেন। এর আগে ২৪ জুলাই উপজেলার বাঁশবাড়িয়ায় সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে সাঁতার কেটে উপকূল থেকে অনেক দূরে চলে যান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী হাসান মারুফ ও এনায়েতুল্লাহ। পরে সেখানেই ঢেউ ও স্রোতের টানে তাঁদের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল রাতভর অভিযান চালিয়ে সকালে তাঁদের লাশ উদ্ধার করে। এর আগে ৫ জুলাই উপজেলার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে মেহেদী হাসান (১৬) নামের আরও এক কিশোর নিহত হয়। ২ জুলাই উপজেলার পন্থিছিলা ঝরঝরি ঝর্ণায় সেলফি তুলতে গিয়ে মো. আসিফ (২১) নামের এক পর্যটকের মৃত্যু হয়।
ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বন বিভাগ, পর্যটন স্পটের ইজারাদার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে দুর্ঘটনায় পর্যটকদের হতাহতের পাঁচটি কারণ জানা গেছে। যে পাঁচ কারণে এসব দুর্ঘটনা হচ্ছে, সেগুলো হলো– পর্যটকদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, পর্যটন স্পটে নিরাপত্তার অভাব, অভিভাবকদের উদাসীনতা, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ও পর্যটন স্পটে মাদক গ্রহণ।
বাঁশবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী জাহাঙ্গীর বলেন, পর্যটকদের দায়িত্বহীনতার কারণেই বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। আমার এলাকায় বিলাসী নামে একটি ঝর্ণা আছে, সেটা আমিও জানতাম না। ঝর্ণাটি দেখতে গহীন অরণ্যের মধ্যে হেঁটে যেতে হয়। এছাড়া সমুদ্রে বা ঝর্ণাতে নেমে যারা সাঁতার জানেন না, তাঁদের বাড়তি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে তিন পর্যটকের প্রাণহানির ঘটনার পর তারা দুর্ঘটনা এড়াতে সৈকত এলাকায় মাইকিং ও সচেতনতামূলক নানা ধরনের দিকনির্দেশনা টাঙ্গিয়ে ছিলেন। স্থানীয়দের নিয়ে সৈকতে চালিয়েছিলেন সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান। কিন্তু সৈকতে আসা পর্যটকরা জোয়ার–ভাটার সময়কে উপেক্ষা করে সমুদ্রে নেমে পড়েন। যার ফলে ঘটে প্রাণহানির ঘটনা।
ফায়ার সার্ভিসের কুমিরা স্টেশনের কর্মকর্তা ফিরোজ মিয়া বলেন, যারা একদম সাঁতার জানেন না কিংবা কম সাঁতার জানেন, তাদের অবশ্যই পানিতে নামতে দেওয়া উচিত নয়। যেখানে বিপজ্জনক গর্ত কিংবা পানির গভীরতা বেশি, সেখানে অবশ্যই সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগাতে হবে।
উপজেলার বারৈয়ারঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীন সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা–২, মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া, নাপিত্তা ছড়া ঝর্ণাসহ অনেক ঝর্ণা রয়েছে, যেগুলো বন
বিভাগ ইজারা দিয়েছে। এছাড়া সীতাকুণ্ডের বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কে সহস্রধারা–১ ও সুপ্ত ধারা নামের দুটি ঝর্ণা রয়েছে। ইকোপার্কটিও ইজারা দিয়েছে বন বিভাগ। এসব স্পটে ইজারাদারদের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো হলেও পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক নেই। পর্যটকদের নিরাপদ রাখারও ব্যবস্থা নেই।
বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) সভাপতি মো. সরওয়ার উদ্দিন বলেন, আমরা পর্যটকদের জন্য সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি। ঝর্ণা এলাকায় নিরাপদে যাওয়ার জন্য ২০জন ইকো গাইডকে নিয়োগ দিয়েছি। পর্যটকরা যদি ঝর্ণা এলাকায় যাওয়ার সময় ইকো গাইডদের সাথে নিয়ে যান তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
বারৈয়ারঢালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেহান উদ্দিন রেহান বলেন, মূলত দায়িত্বহীনতা ও অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে ঝর্ণার উপরে উঠে সেলফি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান।
বারৈয়ারঢালা রেঞ্জের কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, ঝর্ণাগুলোতে যেন পর্যটকেরা না নেমে ঝর্ণার উপরে উঠে চারপাশে ঘুরে ছবি তুলতে পারেন, সে জন্য একটি প্রকল্প তাঁরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। সেটি বাস্তবায়ন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। এছাড়া পর্যটন স্পটে স্বেচ্ছাসেবক বাড়ানোর জন্যও ইজারাদারদের বলা হয়েছে।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, সীতাকুণ্ডে বিভিন্ন পাহাড়ে সৃষ্ট ঝর্ণা এবং সমুদ্র সৈকত দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসেন। ঝর্ণা এলাকাগুলোতে যদি পর্যটন মন্ত্রণালয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে তাহলে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব। এখানে কোনো নিরাপত্তা না থাকায় ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। পর্যটন এলাকগুলোতে বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শীঘ্রই সর্তকতামূলক সাইনবোর্ড দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।