পতিত জমিতেই লেবু বাগান

পতিত জমিতেই লেবু বাগান

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ পারিবারিকভাবেই স্বর্ণ ব্যবসায়ী পলাশ কর্মকার। পিতা-মাতার বড় ছেলে হওয়ায় পড়াশুনা অবস্থায়ই সংসারের ভার কাঁধে নিতে হয়। পিতার স্বর্ণ ব্যবসার পাশাপাশি নিজে জড়িত সাংবাদিকতার সাথেও। রয়েছে সমবায় সমিতি ও জমিজমার ব্যবসাও। এমন সময়ই শ্বশুরবাড়ি যশোরের একটি লেবুবাগান দেখে মন কাড়ে তার। শেষমেষ সখের বসেই সখের আর এক্স মটর সাইকেল বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন দেড়শ’ সিডলেস চায়না থ্রি কাগজী লেবুর কলমের চারা। বাংলাদেশসহ সারাবিশ^ যখন করোনা মহামারীতে আক্রান্ত ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ ২০২০ সালের জুন মাসের কথা এটি। ওইসময় তিনি পৈত্রিক ৩৩ শতক পতিত জমিতে চারাগুলো রোপন করে এখন অনেকটাই সফল।
উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার এক সময়ের কোলকাতা কেন্দ্রিক বাণিজ্যের প্রধান স্থান কপিলমুনির উত্তর নাছিরপুর গ্রামে সাংবাদিক পলাশ কর্মকারের এ বাগান। বাবা সুকুমার কর্মকারের নামানুসারেই বাগানটির নাম দেওয়া হয়েছে এস.কে লেমন গার্ডেন এন্ড নার্সারী। বর্তমানে ওই নার্সারী থেকে বছরে ৪০ হাজার টাকার লেবু ও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার চারা বিক্রি হয় বলে জানালেন তিনি। এটি তার বাড়তি আয়। এক সময় ওই জমিতে কোন ফসলই হতো না।
সম্প্রতি তার ওই বাগান পরিদর্শনকালে দেখা যায় প্রতিটি গাছেই রয়েছে বিভিন্ন সাইজের লেবু। ধরেছে ফুলও। এ প্রসঙ্গে পলাশ কর্মকার বলেন, এ লেবুর সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে সারাবছরই এ থেকে ফলন পাওয়া যায়। পরিচর্চায়ও খুব বেশি একটি সময় দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। অবসর সময়ে শুধুমাত্র কিছুটা আগাছা বেছে দেওয়া ও পানি দিলেই হয়। পানি দিতেও সার্বক্ষণিক সময় দিতে হয়না উল্লেখ করে তিনি জানান, মূলত: ভূ-গর্ভস্থ পানি মেশিন দিয়ে তুলে সেচ করা হয়। এজন্য লম্বা পাইপের মাধ্যমে শুধুমাত্র পাইপটি বাগানে ফেলে রাখলেই হয়। সেখান থেকে বাগানের ড্রেনের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে পানি।
শুরুর কথা ঃ এস.কে লেমন গার্ডেন এন্ড নার্সারীর শুরুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার শশুর বাড়ি যশোরে। সেখানে বেড়াতে গিয়ে বিভিন্ন লেবু বাগান দেখে তার সখ হয়। কথা বলেন সেখানকার চাষীদের সাথে। এক পর্যায়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর এবং সাজিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা সুমন আহমেদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দেড়শ’ লেবু চারা কেনেন। ওইসময় তার কাছে নগদ টাকা না থাকায় তার সখের আর এক্স মটর সাইকেলটি বিক্রি করেন ৩৭ হাজার টাকায়। তা’ দিয়েই মূলত: তার বাগানের যাত্রা।
বাগান তৈরি করেন যেভাবে ঃ সীডলেস লেবু চারাগুলো যার কাছ থেকে কেনেন তার পরামর্শক্রমেই প্রথমে বাগান তৈরি করেন পলাশ কর্মকার। তিনি বলেন, জমিতে প্রথমে ৮০ ড্রাম গোবর ফেলেন। এরপর ১০/১২দিনের মাথায় সেখানে ট্রাকটর দিয়ে চাষ করে গোবরগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। তারপর জমিতে ছয় হাত অন্তর উচুঁ করে সেখানে ফুরডান নামক কেঁচো বা পোকা নাশক দানা ওষুধ দিয়ে চারাগুলো লাগানো হয়। ফুরডান নামক ওষুধ দেওয়ার ফলে মাটিতে থাকা কেঁচো বা অন্য কোন ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে গাছটি রক্ষা পায়।
ফলন পাওয়া যায় যখন ঃ কথা প্রসঙ্গে পলাশ কর্মকার বলেন, ডিসলেস চায়না থ্রি কাগজী লেবুর চারা রোপনের মাস দুয়েকের মধ্যেই গাছে ফুল আসে। কিন্তু পরবর্তী ছয়মাস পর্যন্ত ফুলগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হয়। এর ফলে গাছগুলোর পুষ্টিগুন বাড়ে। ছয়মাস পর থেকে ফুলগুলো রেখে দেওয়ার দু’মাসের মধ্যেই ফলন পাওয়া যায়। এরপর ওই ফলন হয় সারাবছরই।
গাছের স্থায়িত্ব ঃ লেবু চারাগুলো ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত একটানা ফলন দেয় বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি এ থেকে ১২মাসই কলমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করে বিক্রি করা যায়। অর্থাৎ ১০/১২ বছর পর গাছগুলোর ফলন যখন ধীরে ধীরে কমে যাবে তখন ওই গাছ দিয়েই উৎপাদিত চারা আবারও রোপন করা যাবে। সুতরাং বাগান তৈরির শুরুতেই যে খরচ। এরপর আর তেমন কোন খরচ নেই। শুধুমাত্র অবসর সময়ে কিছুটা পরিচর্চা করলেই ফলন মিলবে।
বাজারজাত ঃ লেবুর চাহিদা থাকে সারাবছরই। বিশেষ করে হোটেল-রেস্তোরায় লেবু চলে সবসময়। এজন্য নিজেকে কোন পরিশ্রমও করতে হয়না। বাগান থেকেই ক্রেতারা এসে কিনে নিয়ে যান লেবুগুলো। আবার কলমের তৈরি চারাগুলোও কিনে নিয়ে থাকেন ক্রেতারা। বর্তমানে প্রতি পিস লেবু পাঁচ টাকা বিক্রি করলেও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রতি পিস আট টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় বলেও তিনি জানান। এভাবেই লেবু ও চারা বিক্রির কথা জানালেন উদ্যোক্তা পলাশ কর্মকার।
উদ্যোক্তা তৈরি ঃ পলাশ কর্মকারের ওই বাগান দেখে স্থানীয় কিছু উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছেন। ইতোমধ্যে তার কাছ থেকে চারা কিনে বাগান তৈরি করেছেন অনেকেই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের সুরকার, গীতিকার, শিল্পী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং একাধিক বইয়ের লেখক জিএম এমদাদ এবং সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা, ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের(কেকেএসপি) সভাপতি এবং তালার কানাইদিয়ার বাসিন্দা আব্দুর রশীদ।
বেকারদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ ঃ বেকার যুব সমাজের উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিতে গিয়ে পলাশ কর্মকার বলেন, অনেকেই লেখাপড়া শিখে চাকরীর জন্য বেকার ঘুরে বেড়ান। কিন্তু তাদের হয়তো থাকতে পারে এমন পৈত্রিক অথবা পাশর্^বর্তী কারও পতিত জমি। সেগুলো নিয়ে নিজেরাই এমন কিছু করলে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হবে তেমনি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে তার পরিবার সর্বোপরি দেশ।
চ্যালেঞ্জ ঃ সীড লেস চায়না থ্রি কাগজী লেবু চাষে শুধু যে সফলতার আশা করা যায় তাই নয়। বরং এর শুরুতেই থাকে কিছু চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা গেলে পরে আর কোন সমস্যা থাকেনা বলেও উল্লেখ করেন পলাশ কর্মকার। তিনি বলেন, শুরুতে কিছুদিনের মধ্যেই ছত্রাক জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। লাগতে পারে পিপড়াও। এজন্য না ঘাবড়িয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে ছত্রাকনাশক স্প্রে করলেই হবে। গাছে ফলন ধরলে ফলন বৃদ্ধির জন্য এক প্রকার ভিটামিনও স্প্রে করা যেতে পারে। তার এ বাগান তৈরির কিছুদিন পর অর্ধেকের মতো গাছ মরে গিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরপর প্রায় লাখ টাকার মাটি কিনে আইল তৈরি সেখানে আবারো চারা রোপন করেন। অর্থাৎ প্রথম কিছুদিন একটু নজরদারি রাখতে পারলেই পরে আর তেমন সমস্যা থাকে না বলেও জানান তিনি। ধীরে ধীরে গাছগুলো যখন বড় হয়ে যায় তখন পরিচর্চাও কমে যায় বলেও জানান পলাশ কর্মকার।
উদ্যোক্তাদের বক্তব্য ঃ পলাশ কর্মকারের বাড়তি আয়ের এ উদ্যোগ দেখে একই এলাকার সাংবাদিক, শিল্পী জিএম এমদাদও শতাধিক চারা কিনে বাগান করেছেন। তিনি বলেন, তার জন্যও একটি বাড়তি আয়ের পথ সৃষ্টি হয়েছে। একজন সাংবাদিক হয়েও এভাবে মাটির সাথে শ্রম দিয়ে পলাশ কর্মকার যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সেটি তার জন্যও একটি শিক্ষা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কপিলমুনি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (কেকেএসপি)’র সভাপতি ও সাবেক ব্যাংক ম্যানেজার শেখ আব্দুর রশিদ বলেন, তিনি কপিলমুনির এসকে লেমন গার্ডেন থেকে আড়াই বছর আগে ৫০ পিস কলম সংগ্রহ করে তালার কানাইদিয়া গ্রামের বাড়িতে একটি বাগান তৈরি করেন। বর্তমানে তিনি লেবু ও কলম বিক্রি করে ভালো লাভ পাচ্ছেন বলেও জানান।
কৃষি বিভাগের বক্তব্য ঃ পাইকগাছা উপজেলা কৃষি অফিসার অসীম কুমার দাশ বলেন, উপকূলীয় এলাকায় এমনিতেই লবণের কারণে সব ফসলের ওপর প্রভাব পড়ে। তার পরেও ইতোমধ্যে অনেকেই সীডলেস লেবু বাগান করে সফল হয়েছেন। লেবু গাছের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যে, এতে সময় দেওয়া লাগে খুব কম। তাছাড়া বাড়ির আঙিনায় বা পতিত জমিতেও লেবু চারা রোপন করা যায়। এমনকি লেবু চারা দিয়ে জমির সীমানা দেওয়াও খুব সহজ। এতে একদিকে অন্যান্য ফসল রক্ষা হয় এবং লেবুও পাওয়া যায়।

 

Explore More Districts